বোরিয়াদা, নেবে একটা ইন্টারভিউ!‌

স্বরূপ গোস্বামী

বোরিয়াদা,

 

সম্পর্কটা অনেকদিনের। এভাবে চিড় ধরবে, ভাবিনি। কিন্তু সব চিত্রনাট্যের ওপর তো আমাদের হাত থাকে না। আমাদের অজান্তেই অনেক চিত্রনাট্য লেখা হয়ে যায়।

 

সেই সময় আমি জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছি। এমনিতেই মন খারাপ। অন্য সময় হলে তবু লড়াই করে ফিরে আসার একটা সুযোগ থাকে। এভাবেই তো কতবার বাদ গেছি। কতবার ফিরেও এসেছি। কিন্তু এবার পরিস্থিতিটা ছিল অন্যরকম। আমাকে কার্যত জানিয়েই দেওয়া হয়েছে, আমাকে আর লাগবে না। আমার কথা আর ভাবা হচ্ছে না। আমি যেন নিজে থেকে সম্মান বাঁচাতে ‘‌অবসর’‌ ঘোষণা করে ফেলি।

 

এই অবস্থায় একজনের মনের অবস্থা কেমন থাকে, আশা করি তোমার অজানা নয়। আর ঠিক সেই সময়ে তোমার নাছোড়বান্দা আবদার, ইন্টারভিউ চাই। তুমি চাইছিলে, আমি তোমার চ্যানেলে এসে গরম গরম কিছু কথা বলি। বা অভিমানে কেঁদে ফেলি। বা কাউকে অভিযুক্ত করি। কিন্তু বিশ্বাস করো, এগুলোর কোনওটাই আমি চাইছিলাম না। চাইছিলাম একটু আড়াল। চাইছিলাম, এসব চর্চা থেকে একটু দূরে থাকতে। কিন্তু তুমিও নাছোড়বান্দা, ইন্টারভিউ দিতেই হবে। না দিলে কী কী হবে, হুমকির সুরে তাও প্রায় বুঝিয়ে দিলে। এক ধাক্কায় আমি যখন জেরবার, তখন তুমিও কিনা হুমকি দিয়ে চলেছো। আমার মনের অবস্থাটা একবারও বোঝার চেষ্টা করলে না!‌

 

এমনিতে আমি কাউকে অসম্মান করি না। একজনের কথা আরেকজনকে বলেও বেড়াই না। কিছুটা গুটিয়েই থাকি। কিন্তু সেদিন আর পারিনি। বাধ্য হয়ে তোমার হুমকির সেই স্ক্রিনশট শেয়ার করতে হয়েছিল। সেটা নিয়ে যে এমন হইচই পড়ে যাবে, বুঝতে পারিনি। তারপর কী কী হল, তা সবাই জানে।

 

তুমি জানো, আমি একটু লাজুক। খুব বেশি কথা বলি না। আমার কোনও ফসবুক অ্যাকাউন্টও নেই। তাই আমার ফেসবুক পোস্ট থেকে কোনও খবর হয় না। আসলে, আমি নিজেও ‘‌খবর’‌ থেকে একটু দূরে দূরেই থাকি। বেচারা রোমি (‌আমার স্ত্রী)‌। সে বড্ড আবেগপ্রবণ। কষ্ট পেলে ফেসবুকে দু–‌চার কথা লিখে ফেলে। সেখান থেকে হইচই শুরু হয়ে যায়। আমার বিড়ম্বনা আরও বেড়ে যায়। আমি আমার যন্ত্রণা চেপে রাখতে পারি। কিন্তু তার আবেগ তো আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমি জানি, অফস্টাম্পের বাইরের বল ছাড়তে। রোমি তো ক্রিকেট খেলেনি। ও বেচারা জানবে কী করে!‌

 

আমার কাজ উইকেট কিপিং করা। ব্যাট করার সুযোগ পেলে, রান করা। এইটুকু নিয়েই খুশি থাকি। তাই বলে কি আমার মনে যন্ত্রণা নেই!‌ নিশ্চয় আছে। কিন্তু সেই যন্ত্রণাকে বেআব্রু করে সহানুভূতি চাই না। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব?‌ বছরের পর বছর, আমি টেস্ট খেলার সুযোগই পাইনি। এম এস ধোনি নামক প্রকাণ্ড ছায়ার আড়ালে ঢাকাই পড়ে গিয়েছিলাম। ধোনি দলের অধিনায়ক। সে তো খেলবেই। আর উইকেট কিপারের জায়গা তো একটাই। ফলে, আমাকে বসেই থাকতে হবে। এই নিয়তি মেনেই নিয়েছিলাম। শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, আরও কতজনের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে। বেশিদূর যেতে হবে না। আমাদের এই বাংলার মাধু স্যারের (‌সম্বরণ ব্যানার্জি)‌ কথাই ধরো। এক দশক ধরে দেশের দু’‌নম্বর উইকেট কিপার। কিন্তু টেস্ট খেলার সুযোগই এল না। কারণ, তখন দাপটের সঙ্গে খেলে যাচ্ছেন সৈয়দ কিরমানি।

 

ধোনি অবসর নেওয়ার পর টেস্টে যদিও বা সুযোগ এল, কিন্তু আমার বয়স তখন অনেকটাই বেড়ে গেছে। তবু চেষ্টা করেছি, ফিটনেস ধরে রাখার। চেষ্টা করেছি নিজের সেরাটা দিতে। অনেকে যখন বলে, ঋদ্ধিমানই দেশের সেরা উইকেটকিপার, মনে মনে বেশ গর্বই হয়। টেস্টে যদিও বা সুযোগ এল, একদিনের ক্রিকেটে সেই ব্রাত্যই থেকে গেলাম। জানো, গত বারো বছরে আমি দেশের হয়ে কটা একদিনের ম্যাচে খেলেছি?‌ মাত্র ৮ টা। হ্যাঁ, ৮ টা। আইপিএল ভাগ্যও যে খুব ভাল, তাই বা বলি কী করে!‌ নিজের শহর আমাকে বছরের পর বছর ব্রাত্য রেখেছে। তিন বছর ছিলাম এমন একটা দলে, যে দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। ফলে, জাতীয় দলে যেমন ‘‌নিষ্ফলের হতাশের দলে’‌ থাকতে হয়েছে, আইপিএলেও তাই। পাঞ্জাবের হয়ে ফাইনালে একবার সেঞ্চুরি করলাম। সেবার চ্যাম্পিয়ন কলকাতা। বিজয়োল্লাস আর ঢক্কানিনাদে আমার ওই ইনিংসটা হারিয়েই গেল।

 

এবারের কথাই ধরো। দশটা দল। তার মানে, অন্তত কুড়ি জন উইকেট কিপার লাগবেই। অথচ, প্রথম দিনের নিলামে আমি কিনা ‘‌আনসোল্ড’‌! আমি নাকি দেশের সেরা উইকেট কিপার। অথচ, কুড়ি জন উইকেট কিপারের মধ্যেও আমার কথা মনে পড়ল না!‌ এমনকি নিলামে নাম‌ ডাকার পরেও সব দল মুখ ফিরিয়ে নিল!‌ পরের দিন নিলামে আবার নাম উঠল। শুনছিলাম, কলকাতা নাকি এবার আমার জন্য ঝাঁপাবে। কিন্তু আমার নাম ওঠার পর ওদের হাবভাব দেখে মনে হল, ওরা ঋদ্ধিমান সাহার নামটাই শোনেনি। চেন্নাই, পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ যেসব দলে এতদিন খেলেছি, তারাও হাত গুটিয়ে রইল!‌ মুম্বই যদিও বা শুরুতে হাত তুলল, পরে আর এগোলো না। আমার জায়গা হল গুজরাটে। বেলাশেষের বাজারে যেমন তরি তরকারির দাম ওঠে না, আমারও দাম উঠল না। এক বছর আগেও যাদের নাম শুনিনি, তারা আমার পাঁচ গুন, ছ’‌গুন দাম পেয়ে গেল। সে পাক গে। সুযোগ তো পেয়েছি।

 

কিন্তু এই গুজরাটে এসেও প্রথম পাঁচ ম্যাচে আমার জায়গা হল না। অর্থাৎ, এখানেও আমি প্রথম পছন্দ নই। যতই শান্ত থাকি, ভেতরে ভেতরে একটা আগুন জ্বলছিল। মনে মনে বলছিলাম, যেটা তোমার হাতে নেই, সেটা নিয়ে ভেবো না। কিন্তু যেটা হাতে আছে, সেখানে কোনও ফাঁকি দিও না। শুরুতেই যখন ২ উইকেট পড়ে গেল, নিজেকে বলেছিলাম, ঋদ্ধি, আজ তোমার দিন। আজ রুখে দাঁড়াতেই হবে। একদিকে দ্রুত রান তোলার তাড়া। অন্যদিকে, উইকেট হারানোও চলবে না। এ যেন সরু তারের ওপর দিয়ে হাঁটা। একটু ভারসাম্যের অভাব হলেই পদস্খলন। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেছি। কিন্তু এতকিছুর পরেও এই ইনিংসের কোনও মূল্য থাকত না যদি সেদিন না জিততাম। রশিদভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। শেষ ওভারে ওর দুরন্ত ব্যাটিং আমাদের জয় এনে দিয়েছে। তাই আমার ইনিংসটা যেন নতুন জীবন পেল।

 

বোরিয়াদা, জানি না, তুমি আমার এই ম্যাচটা দেখেছ কিনা। আমি জানি, তোমার ওপর কীরকম ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস করো, তোমার শাস্তি হোক, চাইনি। তুমি হয়ত ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য একটু বেশিই আগ্রাসী হয়ে পড়েছিলে। সৌরভ গাঙ্গুলি বা বিরাট কোহলির আগ্রাসন যদি দোষের না হয়, তবে তোমার পেশার জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমার আগ্রাসনটাই বা দোষের হবে কেন?‌ তবে কোথাও কোথাও একটু মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তুমি হয়ত সেদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারোনি। বিশ্বাস করো, তোমার নাম সামনে আনতে চাইনি। কোথাও, কোনও কাগজে বা চ্যানেলে তোমার নাম বলিনি। বোর্ডকেও কোনও নালিশ জানাইনি। কিন্তু তোমারও তো শত্রু কম নেই। হয়ত তাদের চাপেই বোর্ড তদন্ত কমিটি গড়ল। ডেকে পাঠাল। না গিয়ে উপায় কী?‌ যেটুকু না বললেই নয়, সেটুকুই বলেছি। শুনলাম, বোর্ড তোমাকে দু’‌বছরের নির্বাসন দিয়েছে। শুনে আর যেই আনন্দ পাক, আমি অন্তত আনন্দ পাইনি। আমার জন্য কারও শাস্তি হোক, এটা চাইনি। কিন্তু জল এতদূর গড়িয়ে গিয়েছিল, ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল।

 

দু’‌বছর তুমি নাকি মাঠে ঢুকতে পারবে না। দু’‌বছর তুমি নাকি কোনও ম্যাচ কভার করতে পারবে না। কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলতে তো বারণ করেনি। বিশ্বাস করো, এখন খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু আইপিএলের কড়াকড়ি আবার অনেক বেশি। এখানে কথায় কথায় প্রোটোকলের চোখরাঙানি। তাই আইপিএল চলাকালীন কোথাও কোনও ইন্টারভিউ দেওয়া যাবে না। কিন্তু শেষ হলে তো দিতে বাধা নেই।

 

সেদিন তুমি বলেছিলে। আজ আমি বলছি। বোরিয়াদা, নেবে একটা ইন্টারভিউ। না নিলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.