অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
টানা আড়াই ঘণ্টা শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসে থাকতে কী লাগে?
টানা আড়াই ঘণ্টা অনাবিল আনন্দে ভেসে যেতে কী লাগে?
অন্ধকার সিনেমা হলে বসে-বসেই দার্জিলিংয়ের ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে কী লাগে?
হাত-পা ছুঁড়ে নাচ নেই! বেধড়ক্কা মারপিট নেই! পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে জোর করে হাসানো নেই! বিকট গানে কান ঝালাপালা হওয়ারও নেই! তবুও ক্লান্তি নেই! হল থেকে বেরিয়ে মনে হবে, আর একটু সময় কেন হল না!
ভাবছেন, এই সব এক সঙ্গে কোথায় পাবেন? তা-ও এমন করোনা আতঙ্কে? উত্তর একটাই, দেখে আসুন ‘টনিক!’ এই টনিক খাওয়ার নয়। এই টনিক উপলব্ধির। এই টনিক হাসি–কান্নার!
’৮৩, পুষ্পা, স্পাইডার ম্যান’, কত বড় বড় বাজেটের সিনেমা! তার মধ্যেও জ্বলজ্বল করছে ‘টনিক’! ঝুলছে ‘হাউসফুল’ বোর্ড! কে বলে বাংলা সিনেমার বাজার নেই!
নিদ্দির্ষ্ট গল্প বলে তেমন কিছুই নেই। অ্যাকশন–রহস্য–রোমাঞ্চও নেই। আছে শুধু এক ‘বুড়ো’-র অভিনয়! বিরাশির পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা গানটাই উত্তর, ‘আয়নাতে, আমি নিজেকে এখনও উনিশ–কুড়ি ভাবি!’
কী অসাধারণ অভিনয়। ভুল বললাম, ‘অভিনয়’ নয়। একেবারে সহজ–সাবলীল পথচলা। যেন কোনও সংলাপ লেখাই হয়নি! পরাণবাবু নিজেই বলে চলেছেন নিজের মতো করে! বাংলা সিনেমার দুর্ভাগ্য, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সে ভাবে কাজে লাগাতে পারল না! ওই এক ‘সিনেমাওয়ালা’ আর এই ‘টনিক’—এই দুটো সিনেমার জন্যই অবশ্য চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যাবেন তিনি!
ছুটির দিনে সিনেমাটা দেখতে গিয়েছিলাম পরিবার ও পরিচিতদের সঙ্গে। ৯ জনের গ্রুপে যেমন আমার ৭৫ বছর বয়সী বাবা ছিল, সাতে পা দেওয়া আমার মেয়েও ছিল। অবাক কাণ্ড, দু’জনেরই উপলব্ধি এক! ‘উফ! কী সিনেমা। আবার দেখতে হবে!’
পরিচালক অভিজিৎ সেনের কৃতিত্ব এখানেই। পাঁচ থেকে পঁচাত্তর, এক সুতোয় বেঁধে রাখতে পেরেছেন তিনি! অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা, অনুপমের গলা দারুণ সুরে বেঁধে দিয়েছেন জিৎ গাঙ্গুলি।
সেইসঙ্গে পুরো দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে পর্দা জোড়া দার্জিলিং। আমার হয়তো আরও ভাল লেগেছে এই কারণেই। সুপ্রিয় দত্তর ক্যামেরায় দার্জিলিংকে যেন আবিষ্কার করলাম নতুন ভাবে। কেন যে বাংলা ছবিতে একটা গানের দৃশ্যে শ্যুট করতে কথায় কথায় বিদেশে ছোটে, কে জানে!
এই সিনেমার পুরোটা জুড়েই পরাণ আর দেব। একজন বয়স্ক দম্পতিকে জীবনের সব আনন্দ দিতে হাজির ‘টনিক’ নামক দেব। কাজের চাপে ছেলে–বৌমারা বাবা–মাকে হয়তো সে ভাবে সময় দিতে পারছেন না। তবে কর্তব্য অবশ্যই পালন করছেন। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবনেরই কাহিনি। তা বলে ছেলেকে ‘ভিলেন’ ভাবারও কারণ নেই। বাবাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে। মূলত, এর উপর নির্ভর করেই এগিয়েছে সিনেমা। ওই যে বললাম, গল্প বলে কিছু নেই। আছে শুধু দুরন্ত অভিনয়। মদ্যপানের অভিনয় এত ভাল করা যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে না দেখলে বিশ্বাসই হত না! ‘কাকা, গ্লাস তো পুরো ফাঁকা’—টনিক দেবের এই ডায়লগই যেন সেরার পুরস্কার পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের!
‘টনিক’ শিক্ষা দিয়ে যাবে জীবনে অসম্ভব বলে কিছু নেই। সকালে দু’বার কাশলে যাঁরা ডাক্তারের কাছে ছোটেন, অফিসে ছুটি নেওয়ার তাল খোঁজেন, দিনের ২০ ঘণ্টা ওষুধ আর অসুখের আলোচনা করে কাটান, তাঁদের তো অবশ্যই দেখা উচিত। ’৮২ বছরেও তিস্তার প্রবল স্রোতে র্যাফটিং, ডেলোর আকাশে প্যারাগ্লাইডিং, দার্জিলিংয়ে দড়ি ধরে মাউন্টেনিং—পরাণবাবু দেখিয়ে দিলেন বয়স সত্যিই একটা সংখ্যামাত্র!
ধন্যবাদ দিতেই হবে দেবকে। তিনি এই ছবির সহ প্রযোজক। শুধু এ বার নয়, অনেক দিন ধরেই বাংলা সিনেমায় নতুন একটা হাওয়া আনতে চাইছেন দেব। বস্তাপচা প্যানপ্যানানি নয়, দক্ষিণের কপি পেস্টও নয়, প্রবল ঝুঁকি নিয়ে দেব যে তাঁর ‘সুপারস্টার’ ইমেজ থেকে বের হতে চাইছেন, এর জন্যই বারবার ধন্যবাদ তাঁকে। বাংলা সিনেমাকে বাঁচাতে তিনিই পারেন।
‘টনিক’ ছোট-বড় সবার ছবি! অবশ্যই দেখুন। বারবার দেখুন। আমার মতো সমালোচকের মুখ থেকে প্রশংসা বেরিয়েছে, জেনে রাখুন একশোয়-একশো দেবেন আপনিও!
‘টনিক’, না দেখলে ঠকবেন!