গল্প
ঘুম নেই
পৃথা কুণ্ডু
রাত একটা। ঘুম আসছে না। ডায়রি লিখছিল আল্পনা।
‘বড় দুঃসময় চলছে আমাদের। অতিমারি এসে ওলট পালট করে দিল সব, কেউ বিশ মন চাল আর ছাব্বিশ মন আটা কিনে ঘরে দোর দিয়ে বসে রইলাম, কেউ করোনা নিয়ে কবিতা, প্যারোডি লিখে ভারচুয়াল লাইক পেল বিস্তর, কেউ বা সত্যি সত্যি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন বিপদের দিনে আর পাঁচজনের পাশে একটু দাঁড়াবার। হারালাম অনেক ডাক্তার–সেবাকর্মীকে, কাজ হারালেন অনেকে, আর আমরা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ– আমরা দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে কখন যে চেনা মানুষকে অচেনা হয়ে যেতে দেখলাম আর নিজেকে চিনতেও ভুলে গেলাম, তার হিসেব রাখা হয়নি।’
ঘরে বসেই অনলাইন ক্লাস নেওয়া, স্কুলের অন্যান্য কাজকর্ম করতে হচ্ছে যতটা সম্ভব। সেদিন হেডমিস্ট্রেস ফোন করে আর একটা রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দিলেন। প্রচুর ডেটা চাই, সাজিয়ে গুছিয়ে বানিয়ে আপলোড করতে হবে। হেডমিস্ট্রেস বলেছেন, ‘অন্য কোন কলিগের সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারো, সে তোমাদের ব্যাপার– কিন্তু আমার দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজটা চাই।’ আল্পনা একা তো পারবেই না, কম্পিউটারে খুব একটা সড়গড়ও নয় সে। তার নিজের ল্যাপটপ নেই, ভাইয়েরটা চেয়ে নেওয়াই যায়, কিন্তু ভাইকে কাজটা করে দিতে বলবে সে কোন মুখে? নিজের জ্বালায় নিজেই পাগল হয়ে আছে ছেলেটা। এদিকে বাড়িতে অসুখ–বিসুখ লেগেই আছে। মা, বাবা, জেঠিমা সবাই বয়স্ক, নানা রকম শারীরিক সমস্যা তাঁদের এমনিতেই। ওঁদের নিয়েই বেশি চিন্তা। বাজার–ব্যাঙ্ক সবকিছুই দুই ভাইবোনকে ভাগাভাগি করে করতে হচ্ছে। ছোটন দায়ে পড়ে এসব করছে ঠিকই, কিন্তু বাকি সময়টা কেমন গুম হয়ে থাকছে, আর কিছু বলতে গেলে, বোঝাতে গেলে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক, চাকরিটা দুম করে চলে গেল বেচারার…
কাল সকালে দীপ্তিদিকে ফোন করতে হবে অগত্যা। ও যদি একটু হেল্প করে দেয়, ভাল হয়। দীপ্তিদি অনেক সিনিয়র, একটু মেজাজি, খিটখিটে স্বভাবের। তাকে ঝাড় দেয় প্রায়ই, টেরাব্যাঁকা কথাও শোনায়, তবে তাতে সে কিছু মনে করে না। দীপ্তিদি তার চাইতে পড়াশোনায় অনেক ভাল, কলেজে সুযোগ পাওয়া উচিত ছিল ওর। বিয়ে করেনি, মা মারা যাবার পর অসুস্থ বাবার দেখাশোনা করতে গিয়ে আর পিএইচডিটাও কমপ্লিট করতে পারেনি। এই ছোট স্কুলে সত্যি ওকে মানায় না, সেই ক্ষোভ আর জ্বালা থেকেই ওর মেজাজটা ওরকম হয়ে গেছে। স্কুলের অন্যরা ওকে বলে ‘আঁতেল’। আল্পনার সঙ্গে অবশ্য ওর যুদ্ধ নেই কোন, পিঁপড়ের সঙ্গে কি আর লড়াই করা যায়! এমনিতে ওকে বরং একটু করুণার চোখেই দেখে দীপ্তিদি।
সকালে উঠে ফোনটা করে আল্পনা। বেজে যায় তিন–চারবার। দীপ্তিদি অবশ্য সবসময় ফোন ধরে না। থাক, সন্ধ্যায় আবার করবে। আর দু–একজন যাদের সঙ্গে একটু ভাল সম্পর্ক, তাদের ফোন করে দেখা গেল, কেউই ভাল নেই। হাজারটা অসুবিধে সবার ঘরেই। শুভেন্দুদার কোভিড পজিটিভ হয়েছে, মালাদির অসুস্থ শ্বশুর–শাশুড়ি আর দুটো বাচ্চার পরীক্ষা নিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে। তাঁর আবার বাড়িতে কম্পিউটার নেই, তাও বললেন– হাতে লেখার কিছু থাকলে বল, একটু ফাঁকতালে করে রাখতে পারি। আল্পনা আর কি বলে! ‘ঠিক আছে গো, আমি দেখছি। দরকার হলে বলব।’
সন্ধ্যায় মেসেজটা এল। ‘অনেকবার ফোন করেছিলি। কেন ধরতে পারিনি সেটা জানিয়ে দেওয়া উচিত। বাপি আজ ভোরে চলে গেছে।… ডোন্ট ট্রাই টু কল মি। স্কুলে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি ন্যাকা ন্যাকা সিম্প্যাথি সহ্য করতে পারি না। তোকে বাপি পছন্দ করত, তাই জানালাম। ক্লাসগুলো দু তিনটে দিন পারলে ম্যানেজ করিস।’
আল্পনার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। মেসোমশাই নেই? দীপ্তিদির বাড়ি আগে দু–তিনবার গিয়েছিল সে, স্কুলের কাজেই– ওইটুকু আলাপেই মেসোমশাই কেন কে জানে, ভালবেসে ফেলেছিলেন তাকে। প্রথমে ‘কাকু’ বলে ডেকেছিল আল্পনা, আজকাল সবাই তাই বলে। উনি হেসে বলেছিলেন, ‘তোমার বাবার চেয়ে আমি বোধহয় বড়ই হব মা! আমাদের সময় আমরা বন্ধুবান্ধবের মা–বাবাকে মাসিমা–মেসোমশাই বলতাম।’ সেই থেকে ওঁকে মেসোমশাই বলত আল্পনা। ফোনেও কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার।
দীপ্তিদি নিজেই যখন কথা বলতে চাইছে না, ওকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। ভেবেচিন্তে একটা মেসেজই করে আল্পনা, ‘কী বলব সত্যি জানিনা। মেসোমশাই যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন… তুমি সাবধানে থেকো। তুমি যদি না চাও, আমি কাউকে জানাব না। ক্লাস নিয়ে তুমি চিন্তা কোর না।’
কোন উত্তর আসে না। পরের দিন আবার লেখে আল্পনা, ‘আত্মীয়রা কেউ এসেছেন? চিন্তায় আছি… তোমায় বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু কোন দরকার হলে প্লিজ জানিও।’
সেদিনই ওদের ছাত্রী পায়েল ফোন করে, ‘দিদিমণি, আমার এবার বোধহয় পরীক্ষাটা দেওয়া হবে না।’
—‘কেন? ও হ্যাঁ, তুমি বেশ কয়েকদিন ক্লাসে আসছ না, কী হয়েছে বল তো?’
—‘বাবার চাকরি চলে গেছে দিদি’, প্রায় কেঁদে ফেলে মেয়েটা, ‘ফি দেব কি করে?’
মেয়েটা পড়াশোনায় ভাল। তার এরকম অবস্থা… না না, কিছু একটা করতে হবে।
আল্পনা বলে, ‘তুমি অ্যাপ্লাই কর, আমিও বড়দির সঙ্গে কথা বলছি। নিশ্চয় কন্সিডার করবেন। পরীক্ষার তো এখনও দেরি আছে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক না হলে…’
—‘কিন্তু আমি তো ক্লাস করতেও পারছি না দিদিমণি। ফোনে ডেটা ভরতে অনেক খরচ হয়, বাড়ির এই অবস্থা…’
আল্পনা একটু ভেবে নিয়ে বলে, ‘শোন, তোমার ফোনে আমি ডেটা ভরে দেব, আপত্তি নেই তো?’
—‘না না দিদি, বাবা শুনলে রাগ করবেন!’
—‘রাগ করার কী আছে, আমরাও তো তোমাদের গার্জেনের মত। বাবাকে বুঝিয়ে বোলো, অসুবিধে হবে না।’
ফোনটা রেখে একটা শ্বাস ফেলে আল্পনা। পায়েল তার প্রিয় ছাত্রী, ওর বাড়ির অবস্থা সে জানে, তাই সহজে কথাটা বলে দিতে পারল। কিন্তু এমন আরও কতজন তো আছে, সবার কথা সে জানেও না, আর জানলেও… কতজনের পাশে দাঁড়াবার ক্ষমতা আছে তার? নিজের ভাইটার অবস্থা দেখে তার বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার জন্যই সে কিছু করতে পারছে কি? ‘এত ভাবছিস কেন, আমার তো চাকরি আছে, বাবার পেনশন আছে, তুই নতুন করে চাকরির পরীক্ষাগুলোর জন্য পড়াশোনা শুরু কর না, একটা না একটা হয়ে যাবে’– এরকম কটা ফাঁকা সান্ত্বনার কথা বলার বেশি আর কী বা করতে পারে সে! ছোটন রেগে যায় এসব শুনলে, ‘আমাদের লাইনের কিছু জানিস না বুঝিস না, বকতে আসিস না! কত টাফ এখন নতুন কিছু পাওয়া, জানিস? নিজে জেনারেল লাইনে একটা চাকরি পেয়েছিস বলে ভাবিস দুনিয়াটা এমনি এমনি চলছে! তোদের ওইসব পাতি ইমোশনাল কথা শুনলে না… ডিসগাসটিং!’ ছোটন কাজ করত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে, পায়েলের বাবা একটা ছোট ছাপাখানার কর্মী ছিলেন। এই দুঃসময় এসে সব একাকার করে দিল।
দু দিন পরে মাঝরাতে হঠাৎ ফোন। ওপারে দীপ্তিদি। ফ্যাসফেসে, ঠাণ্ডা গলা— ‘সেদিন কেন ফোন করছিলি বল।’
—‘সে কিছু না, তুমি… তুমি ঠিক আছো তো? কে আছেন তোমার সাথে?’
—‘কেউ নেই। মামা দিল্লিতে, আসতে পারে নি। পিসতুতো ভাই সেদিন এসেছিল, আজ সকালে চলে গেল, কাজের দিন আবার আসবে। পাড়ার দু–একজন হেল্প করেছে। কাজটা তো ছোট করে হলেও করতে হবে, বাধ্য হচ্ছি ওদের হেল্প নিতে।’
—‘এখন তো পারশিয়াল লকডাউন,… আমি কিন্তু যেতে পারি, কোন দরকার হলে…’
—‘তুই অতদূর থেকে এসে কী করবি? বোকার মত কথা বলিস না। যাকগে, কী জন্য ফোন করেছিলি বল। স্কুলের কাজ নিশ্চয়? বল, বল… রাতে ঘুমোতে পারছি না, কাজ করি বরং। কাল থেকে ক্লাসও নেব।’
জোর করে নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু দীপ্তিদির কথাবার্তা স্বাভাবিক লাগছে না মোটেই। ওর মনের ভেতরে ভাঙন ধরছে, আল্পনা বুঝতে পারে। জীবনে এই প্রথমবার, দীপ্তিদিকে একটু শাসনের সুরে বলে সে, ‘না, তোমায় এখন ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি সামলে নেব। ক্লাস তুমি চাইলে নিতেই পারো, যদি বাচ্চাদের সাথে একটু সময় কাটালে তোমার ভাল লাগে, কিন্তু অন্য কাজের চাপ এখন তোমায় নিতে হবে না। তুমি একা আছ, খুব কষ্ট হচ্ছে জানি, কিন্তু… মেনে নিতে হবে দীপ্তিদি, কী করবে বলো!’
ওপাশ থেকে আবার বলে ওঠে অস্বাভাবিক কঠিন স্বরটা– ‘জানি। এতদিন খুব সাবধানে থাকতাম, ভয়ে ভয়ে… আমার কিছু হয়ে গেলে বুড়োটার যদি… এবার যা খুশি করব, বাইরে বেরব, মাস্ক টাস্ক কিচ্ছু পরব না! করোনা হলে ভালই হয়, আর তো আমার কোন পিছুটান নেই…’
—‘কী বলছ কী! ওসব বলতে নেই। শোন– আমি, তুমি, মালাদি, বস্তির বাচ্চাগুলো, পায়েলের বাবা, রাস্তার কুকুরগুলো… কেউ ভালো নেই দীপ্তিদি! একটা দুঃসময় চলছে আমাদের সব্বার… তবু তো আমাদের বাঁচতে হবে, একদম উল্টোপাল্টা ভাববে না।’
—‘বাপিও এইসব বলত, জানিস। মা চলে যাবার পর এইসব বলেই ভুলিয়ে রেখেছিল আমায়। দীক্ষা নিয়েছিল, খুব ভগবানে বিশ্বাস ছিল– বলত, কারও ক্ষতি না করে সৎ ভাবে জীবন কাটাচ্ছি, আমরা খারাপ থাকতে যাব কেন? ভাল মানুষদের পাশে কাউকে না কাউকে ঠিক ঈশ্বর জুটিয়ে দেন।… এবার জবাব দিক, এই যে আমাকে একা করে দিলেন ভগবান, এবার আমি কী নিয়ে থাকব, কেন থাকব?’
—‘প্লিজ তুমি এরকম কোর না। এরকম করলে কি উনি শান্তি পাবেন, বলো?’
—‘আমি তো কোনদিনই বাপিকে সুখী করতে পারিনি। অনেক স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে, সেসব হতে পারিনি। তবে মুখ ফুটে কিছু বলত না। শেষ ইচ্ছেটাও পূর্ণ করতে পারিনি, জানিস! দুদিন আগে একটা গান শুনতে চেয়েছিল, ক্যাসেটে। অনেক আগে একটা জলসায় নিজেই লাইভ রেকর্ড করেছিল, সেটার ওপর আবার অটোগ্রাফ নিয়েছিল পরে। বলেছিল, তোদের ওই ইউটিউবে শুনব না, কানে লাগে। ওই ক্যাসেটটা খুঁজে দে। খুঁজে পাইনি, রাগ দেখিয়ে বলেছিলাম– সে কোন্ কালের জিনিস, কোথায় পড়ে আছে আমি এখন খুঁজতে পারব না অত। তার পর দিন থেকেই শরীরটা যেন বেশি খারাপ হয়ে পড়ল…’
—‘কী গান গো?’ আল্পনা জানতে চায়।
—‘ওই যে, কি যেন– লহো লহো তুলে লহো..’
—‘নীরব বীণাখানি, তোমার নন্দন নিকুঞ্জ হতে সুর দেহো তায় আনি…’ আল্পনা খেই ধরে বলে ওঠে।
—‘তুই জানিস পুরোটা?… কর তো।’
—‘আ– আমি?”
—‘হ্যাঁ কর। আমি শুনে শুনে তুলে নেব। তারপর বাপিকে শোনাব নিজেই। বাপির ফেভারিট আর্টিস্টের মত হবে না, তবু লাইভ তো হবে!’
দীপ্তিদির বাবা গান খুব ভালবাসতেন, জানে আল্পনা। গল্প করতে করতে তাকে একবার বলেছিলেন তাঁর যৌবনকালের অনেক পাগলামির কথা, রাতবিরেতে কোথাও জলসা হলেই নাকি শুনতে ছুটে যেতেন। সঙ্গে থাকত টেপ রেকর্ডার। লাইভ রেকর্ড করে আনতেন সেকালের বিখ্যাত শিল্পীদের গান। সেসব গল্প শুনতে আল্পনারও ভাল লাগত। দীপ্তিদি এখন যা চাইছে, এও এক ধরনের পাগলামি। কিন্তু তাই করতে হবে। না হলে ওর মন শান্ত হবে না। এইটুকু তো করতেই পারে আল্পনা। আস্তে আস্তে সে ধরে, ‘লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি…’
গানটা তারও খুব প্রিয়। বহুবার শুনেছে সে। শুনে শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু আজ এভাবে কাজে লাগবে, কে জানত।
‘পাষাণ আমার কঠিন দুখে তোমায় কেঁদে বলে
পরশ দিয়ে সরস কর ভাসাও অশ্রুজলে…’
এ গান যতবারই সে নিজে শুনেছে, মনে হয়েছে এই জায়গাটায় এসে পাথর গলে কান্না বেরোতে চায় যেন, যা কিছু অসহায়, অসুন্দর, অসহনীয়– তার চরম বেদনা আশ্রয় খোঁজে সুরে সুরে, সুন্দরের কাছে– ‘শুষ্ক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে, আমার চিত্তমাঝে/শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহো টানি/ ওহে সুন্দর হে সুন্দর।’
ওপারে ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ, ‘এই জন্যই তোকে এত পছন্দ করত রে। তোর সঙ্গে বাপির ভাললাগা, পছন্দ এতটাই মেলে… বলত প্রায়ই…’
কাঁদুক একটু। ওকে থামায় না আল্পনা।
দীপ্তি একটু সামলে নেওয়ার পর গানটা শেষ করে আল্পনা বলে, তুমি ঘুমোবার চেষ্টা কর। কাল আবার ফোন করব।
ফোনটা রেখে জল খেতে ওঠে আল্পনা। দেখে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কে যেন।
—‘কে?’
পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ায় ছোটন।
—‘কি রে, ঘুমোস নি!’ জানতে চায় আল্পনা।
—‘ঘুম আসছে না। বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। তারপর শুনলাম তোর ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। রাত দুপুরে কাকে গান শোনাচ্ছিলি?’
—‘ভেতরে আয়, বলছি সব।’
অনেকদিন পর দিদির ঘরে এসে বিছানায় পা তুলে বসে ছোটন। আল্পনা সবটাই বলে। ছোটন মন দিয়ে শোনে। তারপর বলে, ‘ডোন্ট লেট হার ডু এনিথিং র্যাশ। ওনাকে একটু দেখিস। দরকার হলে এভরি নাইট, একটু একটু করে… শি ইজ ইন আ ডিপ ইমোশনাল নিড অব সামওয়ান টু স্ট্যান্ড বাই হার।’
আল্পনা অবাক হয়ে তাকায়, ‘তুই একথা বলছিস!’
—‘হ্যাঁ রে। আর তোর কীসব কাজ আছে বলছিলি, আমি কিছুটা হলেও করে দেব।’
—‘না না, তোর সময় নষ্ট হবে… তোর এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করা দরকার, কম্পিটিটিভ পরীক্ষাগুলো দিতে হবে তোকে…’
—‘সে আমি করে নেব দি। তোর ওপরেও তো কম চাপ নেই। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড।… শোন না, আজ তোর কাছে শোব একটু? ঘুম পাড়িয়ে দিবি? ছোটবেলার মত!’
—‘আয়, শুয়ে পড়।’ ভাইয়ের চুলটা ঘেঁটে দেয় আল্পনা। আলোটা নিভিয়ে দেয়।
ছোটন বলে, ‘একটা গান কর তো। বেশ লাগছিল।’
—‘তোর পছন্দমত গান মানে তো… আমি তো সেরকম কিছু জানি না।’
—‘এনিথিং সুদিং। একটু ঘুমোতে চাই রে। কতদিন ঘুমোতে পারি না, জানিস!’
আল্পনা চোখের কোণে আসা জলটা চট করে মুছে নেয়। তারপর গুনগুন করে একটা সুর লাগায়, অনেক ছোটবেলায় শোনা, ভালোলাগা একটা গানের সুর— ‘ঘুম যায় ওই চাঁদ…’
ছোটন দিদির বিছানায় আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। হয়ত কাল সকালে উঠে এই রাতটাকে ভুলে যেতে হবে, আবার ঘাড়ে এসে পড়বে দুঃসময়ের রোজনামচার থাবা… তবু, এভাবেই তো চলতে হবে। এই পাশে থাকার, ভালোবেসে থাকার মুহূর্তগুলো কি একেবারেই অলীক, ছায়ার পাখি?
আল্পনারও ঘুম আসছে।