একই গান। কিশোর গেয়েছেন, অন্যরাও গেয়েছেন। কিন্তু রফি, লতা বা আশা নয়, মহাকালের বিচারে শেষমেষ থেকে গেছে কিশোরের গানটাই। মানুষ ‘অশিক্ষিত’ গায়কের গানকেই বুকে ঠাঁই দিয়েছেন। এমনই অনেক গানের কথা তুলে ধরলেন কুণাল দাশগুপ্ত।
স্টিফেন হকিংয়ের সৌজন্যে ব্রহ্মাণ্ড রহস্য হাতের মুঠোয় এলেও এ রহস্যের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষ। সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের স্নায়ুতন্ত্র বিবস হয়ে গেছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাচিহ্ন অমরত্ব লাভ করে জ্বলজ্বল করে চলেছে প্রশ্নটির পাশে। কেন কোনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার না পাওয়া এক ‘অশিক্ষিত’ গায়কের সঙ্গে দৌড়ে বারে বারেই পিছিয়ে পড়তে হয়েছে সারেগামা গুলে খাওয়া শিল্পীদের? মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকার, আশা ভোসলে, পরভীন সুলতানাদের কীভাবে কৃশাণু দে সুলভ ড্রিবলিংয়ে বারেবারেই টপকে গিয়েছিলেন কিশোর কুমার।
ট্যান্ডাম সং-এ (একই গান যখন দুই ভিন্ন শিল্পী গায়) দেখা গিয়েছে কিশোর কুমার তাবড় তাবড় শিল্পীদের থেকে জনপ্রিয়তায় কয়েক যোজন এগিয়ে থেকেছেন। কখনও বা অন্যজনের জামানত জব্দও হয়ে গিয়েছে। ‘প্যার কা মৌসম’ ছবির কথাই ধরা যাক। ‘তুম বিন যাউ কাঁহা’ কিশোর কুমার এবং মহম্মদ রফি দুজনেই গেয়েছিলেন । কোনও সন্দেহ নেই, কিশোর কণ্ঠ এখানে অনেকটাই এগিয়ে। তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’র সুরে গাওয়া এই গান রাহুল দেব বর্মণ কিশোর কুমারকে ভেবেই তৈরি করেছিলেন। তাহলে মুনিমজি ছবি ‘জীবন কে সফর মে রাহি’র ব্যাখ্যা কী হবে ? এখানে লতা মঙ্গেশকার প্রায় নক আউটই হয়ে গিয়েছেন। লতাকে কিশোর কুমার ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সমঝোতা ছবির ‘সমঝোতা গমো সে করলো’ ‘শর্মিলি’ ছবির ‘খিলতেহে গুল ইঁহা’তেও। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গিয়েছে ‘মেহেবুবা’তেও। সেখানে শিবরঞ্জনি রাগের উপর গাওয়া কিশোর কুমারের ‘মেরে নয়না শাওন ভাদো’র জনপ্রিয়তাও প্রশ্নাতীততভাবে লতার থেকে বেশি। আবার মঞ্জিল ছবিতে ‘রিম ঝিম গিরে সাওন’ কিশোর, লতা দুজনেই গেয়েছেন। যথারীতি তৃতীয় গাঙ্গুলি ওভার বাউন্ডারি মেরে দিয়েছে। একই কথা খাটে সওতন ছবির ‘জিন্দেগি প্যার কা গীত হ্যায়’ গানের ক্ষেত্রেও।
কিশোর কুমার টেক্কা দিয়েছিলেন আশা ভোসলেকেও। সেই আশা ছবিতে। ‘ইনা মিনা ডিকা’ গানে কিশোর কুমার পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন আশা ভোঁসলেকে। আবার আন্দাজ ছবিতে ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা’ গানটির দশা ১৯৭৫ সালের শিল্ড ফাইনালের মতোই। কিশোর কুমার পাঁচ গোল চাপিয়ে দিয়েছিলেন আশাকে। আশার গলায় ইওর লিং সেদিন নিতান্তই বেমানান লেগেছিল। মুকাদ্দর কা সিকান্দর ছবির কথাই ধরা যাক। ‘ও সাথীরে, তেরে বিনা ভি ক্যা জিনা’ গানটি কিশোর-আশা দুজনেই গেয়েছেন ? আশার সেই গান কজন শুনেছেন ? বাংলা ছবি জীবন মরনে ‘আমার এ কন্ঠ ভরে’ গানটিতেও আশা কিশোরের থেকে পিছিয়ে ছিলেন জনপ্রিয়তার দৌড়ে।
‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’ কার গান ? সবাই একবাক্যে বলবেন কিশোর কুমারের কথা। কিন্তু ঘটনা হল, তারও দশ বছর আগে রেডিওতে গানটি রেকর্ড করেন শ্যামল মিত্র। অমানুষ ছবিতে সেই শ্যামলই ছিলেন সুরকার। ভোর হয়ে আসার মুহূর্তে নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে উপযুক্ত কোনও গান খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন নিজের রেকর্ড করা সেই পুরানো গানটাই গাইয়ে ছিলেন কিশোর কুমারকে দিয়ে। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া একটা গান যেন অমরত্ব পেয়েছিল কিশোরের গলায়।
এক্কেবারে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী পারভিন সুলতানাকেও পরাজয়ের এমন তিক্ত স্বাদ পেতে হয়েছিল। কুদরত ছবিতে ‘হামে তুমসে প্যার কিতনা’ গানটি কিশোর ও পারভিন দুজনেই গেয়েছিলেন। পারভিন সুলতানার ক্লাসিকাল টাচ ইনিংস ডিফিট খেয়েছিল কিশোর কুমারের সাদামাটা গলার কাছে। এবার সেই মোক্ষম প্রশ্ন, কেন ? উত্তর অজানা। কেমন করে রবি ঠাকুর তাঁর প্রতিভার ফুল ফোটাতেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জানতে চেয়েছিলেন সুকান্ত । আমরাও অশিক্ষিত গলার জনমনে এমন মনোপলির কারণ খুঁজে চলেছি। ষড়যন্ত্রের থেকে হৃদযন্ত্র বেশি গুরুত্ব পেত বলেই কি ? উত্তর জানা নেই। জিজ্ঞাসা চিহ্ন অবিনশ্বর।