অমিত ভট্টাচার্য
চেনা উত্তমকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন একেবারে অচেনা আঙ্গিকে। উত্তম নিজেও বোধ হয় সেটাই চেয়েছিলেন। তাই তাঁর তৈরি চারটি ছবিই একেবারে ভিন্নস্বাদের।
বছর পাঁচেক আগেও এমন সময়েও বেঁচেছিলেন পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছিল। কানে একেবারেই শুনতে পেতেন না। তবু মাঝে মাঝেই উকি দিয়ে যেত মহানায়কের স্মৃতি। এক সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম তাঁর বাড়ি। প্রসঙ্গ অবশ্যই উত্তম কুমার। এক প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলেন অন্য প্রসঙ্গে। তবে যা বলছিলেন, তার মধ্যে কোথাও কোনও অতিরঞ্জন নেই।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের আরও একটা পরিচয় আছে। তিনি সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) ভাই। উত্তমকে নিয়ে বানিয়েছেন চারটি সিনেমা। আর চারটিই একেবারে অন্য ঘরানার। সেই চারটি ছবি হল নিশিপদ্ম, অগ্নীশ্বর, ধন্যি মেয়ে ও মৌচাক। সে অর্থে নায়ক বলতে যা বোঝায়, এই চারটি ছবিতে তেমন ভূমিকায় আদৌ ছিলেন না মহানায়ক।
আলাপটা অনেকদিনের। অরবিন্দবাবু তখন সহকারী পরিচালক। বেশ কয়েকটা ছবিতে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। স্টুডিওপাড়ায় অরবিন্দবাবুর ডাকনাম ছিল ঢুলু বাবু। উত্তম বলতেন, ঢুলুদা। তাঁর স্ক্রিপ্ট বেশ পছন্দ করতেন মহানায়ক।
তার আগে বেশ কয়েকটা ছবি করা হয়ে গিয়েছিল। কম বাজেটের ছবি। সাহস করে উত্তম কুমারকে বলতে পারেননি। অবশ্য পরিচালক হওয়ার স্বপ্নটা উস্কে দিয়েছিলেন উত্তমই, ‘আপনি কেন ছবি বানাচ্ছেন না? আর কতদিন সহকারী থাকবেন? এবার নিজে ছবি পরিচালনা করুন।’ কিছুটা সাহস পেয়েছিলেন ঢুলুবাবু। তাই বলে কি আর উত্তম কুমারকে বলা যায় ?
সাহস করে একদিন বলেই ফেললেন। বিভূতিভূষণের কাহিনি নিয়ে নিশিপদ্ম। যেখানে নায়ক মদ্যপান করে, অবৈধ নারীসঙ্গে আসক্ত। এমন চরিত্রে উত্তম কুমার! কিছুটা সংকোচ ছিল। বলেছিলেন, তোমাকে ওই চরিত্রে ভেবেছি। তুমি কি কাজ করবে? এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন উত্তম। তৈরি হল নিশিপদ্ম। পরে সেই কাহিনি নিয়েই হিন্দিতে ছবি বানিয়েছিলেন শক্তি সামন্ত। ছবির নাম অমর প্রেম, নায়ক রাজেশ খান্না।
এরপর অগ্নীশ্বর। উত্তমের জীবনের স্মরণীয় ছবিগুলির একটি। বেতার জগতের শারদীয়া সংখ্যায় বেরিয়েছিল বনফুলের এই গল্পটি। তখন থেকেই এই গল্প নিয়ে ছবি করার কথা ভেবে আসছিলেন ঢুলু বাবু। কিন্তু এর চিত্রনাট্য তৈরি করা বেশ কঠিন ব্যাপার ছিল। পাঁচটি গল্পকে এক জায়গায় এনে চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়। ছবিটি দেখে অমিতাভ বচ্চন এতটাই অভিভূত ছিলেন, হিন্দিতে ওই ছবি করতে চেয়েছিলেন। অনেকদূর কথা এগিয়েওছিল। কিন্তু শেষমেষ আর হয়ে ওঠেনি।
ধন্যি মেয়ে। ফুটবল নিয়ে এমন একটা ছবি! চিত্রনাট্যের সেই লাইনগুলো মনে করুন, ‘তোমার সংসারের পেনাল্টি বক্সে যে জ্যান্ত বলটা পাঠিয়েছি, তা চেষ্টা করেও কোনওদিন ফেরাতে পারবে না।’ এটাও চিঠির ভাষা হতে পারে! এমন অভিনব কিছু সংলাপের জন্যই ছবিটা অন্য এক মাত্রা পেয়েছে। নায়িকা হিসেবে জয়া ভাদুড়ির পথ চলা এই ছবি থেকেই।
সমরেশ বসুর কাহিনি নিয়ে এরপর করলেন মৌচাক। এখানে উত্তম হলেন রঞ্জিত মল্লিকের বড় দাদা। ছত্রে ছত্রে হাসির উপাদান। অরবিন্দবাবুর কথায়, হাসির ছবি করা কিন্তু সবথেকে কঠিন। দেখতে হবে, সেই হাসির মধ্যে যেন ভাঁড়ামি না এসে যায়।’
কথা ছিল, উত্তম-সুচিত্রা দুজনকে নিয়ে সমরেশ বসুর লেখা নাটের গুরু করবেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। উত্তম মারা যাওয়ার পর সঞ্জীব কুমারকে সঙ্গে নিয়ে সুচিত্রা সেনও নাকি অভিনয় করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাও আর হয়ে ওঠেনি।
টুকরো টুকরো অনেক কথা সেদিন বলেছিলেন বর্ষীয়াণ পরিচালক। যেমন দার্জিলিংয়ে ‘পথে হল দেরী’র শুটিং। ঢুলুবাবু সহকারী পরিচালক। রাতে হোটেলে আড্ডা হচ্ছে। উত্তম কুমার বললেন, আজ আপনাকে ড্রিঙ্ক করিয়েই ছাড়ব।’ ঢুলুবাবুর মুখেই শোনা যাক, ‘আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। কখনও খাইনি। খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। অথচ, সরাসরি উত্তমকে ‘না’ বলি কী করে? ও একটা গ্লাসে ঢেলে দিল। ওরা গল্পে মেতে রইল। দেখলাম, পিছন দিকে একটা পিকদানি। চুপি চুপি সেখানে ঢেলে দিলাম। আমার গ্লাস খালি দেখে উত্তম বলে উঠল, আরে, এর মধ্যে শেষ করে ফেলেছেন? করেছেন কী? তখন সত্যিটা বলেই ফেললাম। শুনে সুচিত্রার সে কী হাসি। বলল, আপনি তো দেখছি উত্তমের থেকেও বড় অভিনেতা। কাউকে কিছু বুঝতেই দিলেন না! তবে, আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না। এসব না খেলে এ লাইনে টিকবেন কী করে!’ পুরানো দিনেই যেন ফিরে যাচ্ছিলেন বর্ষীয়াণ পরিচালক। মুখে অনাবিল হাসি। টুকরো টুকরো এমন কত স্মৃতি ভেসে উঠল।
সেই মানুষটা আর নেই। কয়েক বছর আগেই চিরতরে হারিয়ে গেলেন। কানে শুনতে না পেলেও যাঁর হৃদয়জুড়ে ছিলেন মহানায়ক। যিনি নায়কের গন্ডি ভেঙে একেবারে অন্য এক উত্তমকে হাজির করেছিলেন বাঙালির সামনে।
********************************