সজল মুখার্জি
তাঁর জন্মের তারিখ ১ জুলাই। মৃত্যুর তারিখও সেই ১ জুলাই। বাঙালিকে আর নামটা বলে দেওয়ার দরকার নেই। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর জন্মদিন পালিত হয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে। কিন্তু বাঁকুড়ার সঙ্গেও তাঁর একটা সম্পর্ক থেকে গিয়েছিল। অনেকেই হয়ত জানেন না, ১৯৬২ সালে তিনি এই বাঁকুড়া জেলা থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লড়াই করছেন বাঁকুড়া জেলা থেকে। এমনটা ওই একবারই ঘটেছিল।
হঠাৎ বাঁকুড়ায় দাঁড়াতে গেলেন কেন? তাহলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। আসলে, ১৯৫৭ তে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বৌবাজার কেন্দ্র থেকে। সেবার তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন মহম্মদ ইসমাইল। সেবার খুব অল্প ভোটে জিতেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র। তাই বাষট্টির নির্বাচনের আগে তিনি কিছুটা সতর্ক হয়ে গেলেন। বৌবাজারের বদলে কেন্দ্র পরিবর্তন করে দাঁড়ালেন চৌরঙ্গিতে। কিন্তু চৌরঙ্গি থেকে জিতবেন, এমনটা হয়ত নিশ্চিত ছিলেন না। তাই পাশাপাশি আরও একটি কেন্দ্র থেকে লড়াই করার কথা ভাবলেন। সেই কেন্দ্রটি হল বাঁকুড়ার শালতোড়া। নিশ্চয় দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাঁকুড়া জেলাকে বেছে নেওয়ার মূল কারণ হল, ১৯৫৭–র নির্বাচনে এই জেলার সব আসনেই জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। সেই কারণেই বাঁকুড়াকে তখন কংগ্রেসের দূর্গ বলা হত। তবে, ১৯৫৭ সালে শালতোড়া বলে কোনও কেন্দ্র ছিল না। ৬২ সালে বিধানবাবু লড়বেন বলেই এই কেন্দ্রটি বানানো হল। যেন জিততে কোনও সমস্যা না হয়, সেই ভেবেই ম্যাপ তৈরি হল। অর্থাৎ, কোন কোন অঞ্চল এই বিধানসভায় থাকবে, কোন কোন অঞ্চল থাকবে না, সেটা সাংগঠনিক ক্ষমতা বুঝে ঠিক করা হয়েছিল। এমনকী ১৯৬৭ থেকে শালতোড়া বলে আর কোনও কেন্দ্র রইল না। তখন থেকে কেন্দ্রটির নাম হয়ে গেল গঙ্গাজলঘাটি। শালতোড়ার একটি অংশ চলে এল ছাতনার সঙ্গে। বিধানসভা কেন্দ্র হিসেবে শালতোড়া আবার ফিরে এল ২০১১ সালে।
আবার বিধানচন্দ্র রায়ের কথাতেই ফেরা যাক। সেই সময় বেশ কয়েকদিন তিনি শালতোড়াতেই ছিলেন। থাকতেন মূলত ডাঃ বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জির সরকারি কোয়ার্টারে। সেই সময় তিনি শালতোড়া হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। সরকারি চিকিৎসক হয়েও সক্রিয়ভাবেই যুক্ত ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে। বিধানবাবুর সঙ্গে হয়ত আগে থেকেই আলাপ ছিল। তাছাড়া, বিধানবাবু নিজেও হয়ত অন্য নেতার বাড়িতে না থেকে একজন ডাক্তারের বাড়িতে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
সেই সময় বড় বড় জনসভার তেমন রেওয়াজ ছিল না। তবে বেশ কিছু গ্রামে প্রচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিধানবাবুকে। প্রচারের ফাঁকে বেশ কিছু রোগীও দেখতে হয়েছিল। তখনও সিপিএমের জন্ম হয়নি। ফলে, মূল লড়াইটা ছিল সিপিআই–এর বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বিধানচন্দ্র পেয়েছিলেন ৯৯২৯ টি ভোট। বিশ্বনাথবাবু ৪৫১২। অর্থাৎ জয়ের মার্জিন ৫৪১৭। তখনকার হিসেবে ব্যবধানটা বেশ ভালই। বিরোধীদের আক্রমণের রাস্তায় খুব একটা যেতেন না। বিশেষ কোনও রাজনৈতিক কথাও বলতেন না। বরং, পিছিয়ে পড়া এই এলাকার উন্নয়নের কথাই উঠে আসত তাঁর কথায়। আরও কী কী উন্নয়নের সম্ভাবনা আছে, কোন কোন দিকে জোর দিতে হবে, সেইসব কথা উঠে আসত।
এলাকার মূলত দুটি সমস্যার কথা বেশি করে ভাবিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে। সেই সময় এলাকায় জলের খুব কষ্ট ছিল। যেখানেই প্রচারে গেছেন, মানুষ জলের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। বিশাল আকারের একটি কুয়ো তৈরি হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর লোকমুখে সেই কুয়োর নাম হয়ে যায় বিধান–কুয়ো। সেই কুয়ো এখনও আছে। সেখান থেকেই বিভিন্ন এলাকায় জল সরবরাহ করা হত। আরও একটি ব্যাপারে তিনি অগ্রণী হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এলাকায় একটি হাইস্কুল দরকার। সেই স্কুল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে, সরকারি অনুমোদন তিনি দিয়ে যেতে পারেনননি। কারণ, তার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ তে সেই স্কুল অনুমোদন পায়। নাম হয় বিসি রায় বিদ্যাপীঠ। সেই স্কুলের প্রথম হেডমাস্টার নুজিবর রহমান এলাকার অবিসংবাদী বাম নেতা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিছুটা নস্টাজিক হয়ে পড়েন নুজিবরবাবু, ‘হ্যাঁ, আমিই ওই স্কুলের প্রথম হেডমাস্টার। যেহেতু বিধানবাবুর উদ্যোগেই ওই স্কুল, তাই আমরাও তাঁর নামেই স্কুলের নামকরণ করেছিলাম।’
সেবার চৌরঙ্গি ও শালতোড়া–দুটি আসনেই জিতেছিলেন বিধানবাবু। নিয়ম অনুযায়ী একটি আসন ছেড়ে দিতে হত। তিনি চৌরঙ্গি আসনটিই ধরে রেখেছিলেন। জয়ী হয়েছিলেন জানুয়ারিতে। জুলাই মাসের প্রথম দিনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফলে, আর শালতোড়ায় আসা হয়নি। শোনা যায়, শালতোড়াকে ঘিরেও তাঁর কিছু উন্নয়নের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। শালতোড়ার মানুষের মধ্যে একটা আক্ষেপ থেকেই গেছে। যেভাবে দুর্গাপুর, কল্যাণী, সল্টলেক, চিত্তরঞ্জনেরপ মতো শহর গড়ে উঠেছে, বিধান রায় আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে বাঁকুড়া জেলাতেও তেমন কিছু কর্মকাণ্ড হতে পারত। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত বাঁকুড়াও। হয়ত জন্ম হত নতুন কোনও শহরের। সেই আক্ষেপ, সেই দীর্ঘশ্বাস আজও তাড়া করছে পিছিয়ে পড়া বাঁকুড়াকে।