বইমেলা আছে। অথচ, তুমি থাকবে না? কেন জানি না, এত বছর পরেও মেনে নিতে পারি না। মনে প্রাণে চাই, বইমেলা আবার তোমার বুকেই ফিরে আসুক। আমার মতো অনেকেই হয়ত এমনটাই চায়। বইমেলা ছাড়া তুমিও কি ভাল থাকতে পারো! ফিরে এসো, প্রিয় ময়দান। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
আজ তোমাকে খুব মনে পড়ছে।
না, তুমি কোনও নারী নও। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুও নও। তুমি কলকাতা ময়দান।
সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, গড়ের মাঠ। রাজনীতির সভা হলে শুনতাম, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। দুটোই নাকি ভিক্টোরিয়ার উল্টোদিকে। দুটোই নাকি বেশ বড় মাঠ, এদিক থেকে ওদিকে দেখা যায় না। দুটো যে একই জিনিস, জানতে অনেক সময় লেগেছে। কৈশোর পেরিয়ে সদ্য তারুণ্য। ততদিনে বইমেলা নামক বস্তুটি চিন্তা–চেতনার অনেকটা জায়গা নিয়ে ফেলেছে। দুপুর হলেই ঢুকে পড়তাম বইমেলায়। থাকতাম একেবারে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত। বিরাট যে কেনাকাটা করতাম, এমন নয়। পকেটে তেমন টাকাও থাকত না। তবু কী অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ, কী অদ্ভুত এক শিহরণ। হালকা শীত, মন্দ লাগত না। একটু ধুলো উড়ত, তাও মন্দ লাগত না। মাইকের আওয়াজ, সেটাও বেমানান লাগেনি।
মনে আছে, নব্বইয়ের দশকে সেই ময়দানেই প্রথম দেখি আমার প্রিয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহকে। সম্ভবত দেজ–এর স্টলে বসেছিলেন। সই দিচ্ছিলেন। টপ করে একটা বই কিনে ফেললাম। লেখককে প্রণাম করে বইয়ে সই করিয়ে নিলাম। সেই বইটা আজও সযত্নে সুরক্ষিত। তার আগে বুদ্ধদেব গুহর কত বই পড়েছি। কত কথা জমেছিল। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন কোনও কথাই বলতে পারিনি।
সেই বছরই, বইমেলার শেষদিনে দেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁকেও প্রণাম করেছিলাম। নিজের মুগ্ধতা মেলে ধরেছিলাম। ওই তো জয় গোস্বামী, উনি বোধ হয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। দূর থেকে দেখছিলাম। একটু একটু করে মুগ্ধতা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল সেই তরুণকে।
পরের বছর। হঠাৎ শুনলাম, বইমেলায় আগুন লেগেছে। পরদিন সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম। আমার প্রিয় বইমেলা কি আর হবে না? আগুন তাকে থামিয়ে দেবে? কেন জানি না, সেই পোড়া মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। অদ্ভুত একটা কান্না যেন বুকের মাঝে জমাট বেঁধে ছিল। সেদিন সন্ধেবেলায় আরেকজনের চোখেমুখে সেই যন্ত্রণা দেখেছিলাম, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কীভাবে সেই পুড়ে যাওয়া বইমেলায় আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনলেন, নিজের চোখেই দেখেছি। সেই থেকে মানুষটার প্রতি অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধা এসে গেল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মানে আমার কাছে সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম নয়, আমার কাছে সেই মানুষটা, যিনি নিঃশব্দে বইমেলায় প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন।
কত সময় গড়িয়ে গেল। বইমেলা তোমার থেকে দূরে সরে গেল। কখনও স্টেডিয়াম, কখনও মিলন মেলা, কখনও করুণাময়ী। যাইনি, এমনটা বলব না। তবে সেই আবেগটা যেন ছিল না। বইমেলা কেমন যেন কর্পোরেট হয়ে গেছে। বই কেনার থেকে খাবারের স্টলে লাইন দেওয়ার লোক অনেক বেশি। পাইকারি হারে উঠছে সেলফি। আর ফটাফট পোস্ট হয়ে যাচ্ছে ফেসবুকে। কেমন যেন অচেনা একটা জায়গা। অথচ, এমনটা তো চাইনি।
ময়দানে বইমেলা হলে নাকি দূষণ হত। যেন আর কোথাও দূষণ হয় না। চারিদিকে এত দূষণের ছড়াছড়ি। যত রাগ কিনা বইমেলায়! ওই আহাম্মকদের কী করে বোঝাই, বইয়ের দূ্ষণ স্বাস্থ্যের পক্ষে ও চেতনার পক্ষে মোটেই ক্ষতিকারক নয়। বরং বেশ রোমাঞ্চকর।
বইমেলা আছে। অথচ, তুমি থাকবে না? কেন জানি না, এত বছর পরেও মেনে নিতে পারি না। মনে প্রাণে চাই, বইমেলা আবার তোমার বুকেই ফিরে আসুক। আমার মতো অনেকেই হয়ত এমনটাই চায়। কিন্তু সেই আওয়াজ কে কোথায় পৌঁছে দেবে! বইমেলা বাংলার সেরা মেলা ছিল, আছে, থাকবে। তার সঙ্গে তুমিও থেকো। বইমেলা ছাড়া তুমিও কি ভাল থাকতে পারো!
ফিরে এসো, প্রিয় ময়দান।