অরিত্র গাঙ্গুলি
মলস্রোত মিডিয়া কি মানুষের বিশ্বাস হারাচ্ছে? মাঝে মাঝেই এমন প্রশ্ন উঠে আসে। এই প্রশ্নটা মিডিয়ার পক্ষে খুব একটা সুখকর নয়। এটা ঘটনা, সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মূলস্রোত মিডিয়া অনেক গুরুতর বিষয় চেপে যাচ্ছে।
কিন্তু আমি অন্য একটা বিষয় নিয়ে এই লেখাটা লিখছি। বামপন্থীরা গত এক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে একটা কথা বলে আসছেন, ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের পর থেকে পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। মানুষ লকডাউন দেখেছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায়ভাবে ফিরে আসা দেখেছে। ভোটে এর প্রতিফলন হবেই। মিডিয়া শুধু তৃণমূল আর বিজেপিকে নিয়ে লাফালাফি করছে। বামশক্তিকে ইচ্ছে করেই তারা দেখছে না। গ্রামীণ স্তরে বিজেপি একেবারেই ধসে গেছে। মানুষ আবার বামেদের ছাতার তলায় ফিরে আসছে।
মোটামুটি এই ছিল দাবি। একেবারে উঁচু স্তর থেকে পাড়ার চায়ের দোকান। মূল কথা ছিল, মিডিয়া বাস্তবের মাটি থেকে অনেক দূরে। তারা কর্পোরেট শক্তির দালাল। কর্পোরেটরা যা বলে দেয়, তারা সেটাই দেখায়। কিন্তু গ্রাম বাংলার ছবিটা একেবারেই অন্যরকম।
মানছি, ভোটে লড়ার আগে কেউ হারার কথা বলে না। সেখানে নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে হয়। কর্মীদের মোটিভেট করতে হয়। কিন্তু বাম নেতা কর্মীরা কি নিজেরাও বুঝতে পেরেছিলেন, পরিস্থিতি এরকম হতে পারে? এই দেওয়াল লিখন কি সত্যিই তাঁরা পড়তে পেরেছিলেন। এখন যে যাই দাবি করুক, আসল কথা হল, দেওয়ালের লেখা পড়তে এবারও তাঁদের মস্ত বড় এক ভুল হয়েছিল।
হ্যাঁ, মিডিয়া দিনের পর দিন তৃণমূল আর বিজেপি শিবিরকেই দেখিয়েছে। তাদের কর্মসূচিই দেখিয়েছে। এমনকী এমন লঘু জিনিসকেও দিনের পর দিন প্রাইম টাইমে এনেছে, যেগুলো প্রাইম টাইমে আসার যোগ্যই নয়। এটা নিয়ে আপত্তি, প্রতিবার থাকতেই পারে। কিন্তু বামেরা যে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারবে না, এই সহজ সত্যিটা মিডিয়া বুঝলেও বাম নেতা কর্মীরা বোঝেননি। পাঁচ বছর আগের কথা ভাবুন তো। তখন তো সূর্যকান্ত মিশ্রর সব প্রেস কনফারেন্স প্রায় লাইভ দেখানো হত। জেলায় জেলায় জনসভাও সরাসরি দেখানো হত। ২০২১ যে যে মিডিয়া স্পেস পেয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি মিডিয়া স্পেস পাওয়া গিয়েছিল ২০১৬ তে।
তাহলে এবার কেন মিডিয়ার ফোকাস থেকে হারিয়ে গেল? আসলে, এবার বামেরা আরও বেশি করে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই সহজ বিষয়টা বাম নেতা কর্মীরা কিছুতেই মানতে পারেননি। তাঁরা সমানে তর্ক করে গেছেন। অন্যকে দোষারোপ করে গেছেন। অন্যদের ‘দালাল’ তকমা এঁটে বিকৃত এক আনন্দ পেয়েছেন।
অন্তত ভোটের বাস্তবতাটা মূলস্রোত মিডিয়া ওই বাম নেতাদের থেকে বেশি বোঝে, এটুকু তো প্রমাণ হল। মোদির যেমন নজর ঘুরিয়ে দিতে একটা পাকিস্তান দরকার হয়, কমরেডদেরও তেমনই বোধ হয় মিডিয়া দরকার হয়। এরপরেও কি আত্মসমীক্ষা হবে? নাকি নিজেদের সমস্ত ব্যর্থতার দায় এবারও মিডিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন?
(ওপেন ফোরাম। বেঙ্গল টাইমসে পাঠকের মুক্তচিন্তার মুক্তমঞ্চ। এখানে নানা বিষয়, নানা বিতর্ক উঠে আসে। যুক্তি–পাল্টা যুক্তির লড়াই চলতে থাকে। চাইলে আপনিও অংশ নিতে পারেন। তবে কুৎসা বা ব্যক্তি আক্রমণ নয়, লেখা হোক যুক্তিনিষ্ঠ।)