স্বরূপ গোস্বামী
মাসখানেক আগের কথা। লকডাউনের মাঝেও তাঁর বাড়িতে হাজির আইপ্যাকের লোকজন। প্রশান্ত কিশোরের লোক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলেন। তাঁদের অনুরোধ, আপনি এতবারের বিধায়ক। এলাকায় দারুণ জনপ্রিয়। স্বচ্ছ একটা ভাবমূর্তি রয়েছে। আপনি তৃণমূলে যোগ দিন। আপনাকে শুধু টিকিট দেওয়া নয়, সেই সঙ্গে ক্যাবিনেটেও আনা হবে। তিনি নেহাতই নিরীহ ভদ্রলোক। সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন। এখানেই থামল না। ফোন আসতেই থাকল। গভীর রাতে স্বয়ং পিকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা। একই আশ্বাস। গ্রামের বিধায়ক। গুছিয়ে হিন্দিটা বলতে পারেন না। বাংলা–হিন্দি মিশিয়ে যা বললেন, তার নির্যাস, এই বয়সে আমাকে আর দল বদল করতে বলবেন না। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।
এর ঠিক কয়েক মাস পর। বালুরঘাটের এক আইনজীবী বারবার বলছিলেন, একবার বাড়িতে আসুন। কয়েকটা কথা আছে। দলের অনেকের নামেই ভুয়ো মামলা রয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, সেই সংক্রান্ত কথা। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদার। সেই এক কথা। দাদা, আপনাকে খুব সম্মান করি। আপনার মতো মানুষ বিরল। আপনি আমাদের দলে আসুন। কৈলাশজির সঙ্গে অন্তত একবার কথা বলুন। বিনয়ী বাম বিধায়ক জানালেন, আপনি একজন সাংসদ। কৈলাশজি আরও বড় মাপের নেতা। উনি কী বলবেন, সেটা আমি জানি। আমার উত্তর কী হবে, সেটাও আপনি জানেন। আমি তাঁর মুখের ওপর ‘না’ বললে সেটা তাঁর পক্ষে শোভনীয় হবে না। তাছাড়া, কৈলাশজির কাছে আপনার সম্মানও থাকবে না। দাদা–ভাইয়ের সম্পর্কটুকু থাকুক। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।
ঘটনাগুলো আড়ালেই ছিল। ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানাতে যাননি। তাঁর কোনও ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নেই। ফলে, ফেসবুকেও জানাতে যাননি। দলের কাছেও জানিয়ে নিজের ওজন বাড়াতে চাননি। তাছাড়া, সাংবাদিক সম্মেলন কীভাবে করতে হয়, কীভাবে মিডিয়ায় খবর খাওয়াতে হয়, এগুলো জানেন না। জানার চেষ্টাও করেননি। তাই আড়ালেই থেকে গেছে।
সেই মানুষটি মঙ্গলবার সন্ধেবেলায় মারা গেলেন। তিন চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। কোনও চ্যানেলে উল্লেখটুকুও নেই। নিশ্চিত থাকতে পারেন, কাল অধিকাংশ কাগজে মৃত্যুর খবরটুকুও থাকবে না। কোথাও কোথাও থাকলেও ওই মেরেকেটে পঞ্চাশ–ষাট শব্দ।
টানা সাতবারের বিধায়ক। এমনকী, ২০১১, ২০১৬–এই কঠিন সময়েও তিনি জিতে এসেছেন কুশমন্ডি থেকে। কিন্তু কজন জানেন নর্মদা রায়ের নামটা? টিভিতে যাঁদের ঘটা করে ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ তকমা দিয়ে ডেকে আনা হয়, তাঁরাও জানেন না। কলকাতার মিডিয়া মাতব্বরদের বিদ্যের দৌড় তো ওই কলকাতার কুয়োর মধ্যেই। তাই ভোটের আগে হেভিওয়েট নেতার যে তকমা দেওয়া হয়, সেই তালিকায় দেবাশিস কুমার, অতীন ঘোষ, সুজিত বসুদের নাম থাকে। কিন্তু টানা সাতবারের বিধায়ক নর্মদা রায়ের নাম থাকে না।
থাকার কথাও নয়। সত্যিই তো, নর্মদা রায়কে কলকাতার মিডিয়া কেনই বা চিনতে যাবে? তাঁর বৈশাখীর মতো সুন্দরী বান্ধবী নেই। সারদা কেলেঙ্কারিতে তিনি জড়িয়ে নেই। নারদার ভিডিওতেও তাঁর ছবি নেই। এতদিন বিধায়ক রইলেন, টেবিল ভাঙা–বেঞ্চি ভাঙা, গালাগাল দেওয়া, তেড়ে যাওয়া–কোনও কিছুই করে উঠতে পারলেন না। দলবদল করে ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ শামিল হওয়ার চেষ্টা করেননি। বিজেপিতেও যাননি।
গাদাগাদি করে ভিড় বাসে চড়েই বিধানসভায় যেতেন। দামী গাড়ি তো দূরের কথা, এলাকাতেও কোনও বাহন ছিল না। টোটোয় চড়ে, এর–তার বাইকে চড়েই ঘুরতেন। একেবারে সাদামাঠা জীবন বলতে যা বোঝায়, তাই। অথচ, একজন জনপ্রতিনিধির কী দায়িত্ব, সেই সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল। এলাকার কোন কাজটার জন্য কোন অফিসে যেতে হবে, জানতেন। একদিনের জন্য কলকাতায় এলেও কোনও না কোনও হাসপাতাল ছিল তাঁর অনিবার্য ঠিকানা। পায়ে হেঁটেই পিজি, এনআরএসে পৌঁছে যেতেন। সুপারের সঙ্গে, ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে বসে থেকেছেন। দরকার হলে হাতে–পায়ে ধরেও অচেনা রোগীকে ভর্তি করে তবে ফিরেছেন। কখনও কখনও রাতে হাসপাতালেই থেকে গেছেন। বিধায়ক আবাসে এক ঘরে দুই বিধায়ক। তাঁর ঘর তো প্রায় ধর্মশালা। এলাকার লোক কলকাতায় এলেই আশ্রয় তাঁর ওই ছোট্ট ঘরে। অন্যদের বিছানা ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় মাটিতে শুয়েছেন। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ হয়েও কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে তাঁর ভর্তি করা রোগীর সংখ্যা পাঁচ হাজারের কম নয়। তাঁদের অধিকাংশকে তিনি হয়ত চেনেনও না। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে এই কাজ করে গেছেন। এটা তো গেল শুধু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিষেবা। অন্যান্য দিকগুলো বলতে গেলে আস্ত উপন্যাস হয়ে যাবে।
এমন মানুষকে ভাল না বেসে পারা যায়! এলাকাতেও সেই অকৃত্রিম ভালবাসাটাই পেয়ে এসেছেন। সবার জন্যই অবারিত দ্বার। সবার জন্যই হৃদয়ের একইরকম উষ্ণতা। দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা, কাউকে কখনও ধমক দিয়েছেন, এমন অভিযোগও সম্ভবত নেই। ঔদ্ধত্য শব্দটার সঙ্গে যেন আলোকবর্ষ দূরত্ব। ব্যক্তিগত সততাও যাবতীয় প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। বিধানসভার পিওন থেকে ক্যান্টিন কর্মী, সবাইকে যে মর্যাদা দিয়ে কথা বলতেন, আর কজন বিধায়ক এমনটা বলেন, সন্দেহ আছে। এবার যে সর্বত্র বামেদের হাওয়া ভাল নয়, বিলক্ষণ জানতেন। তাঁকেও হারতে হবে, এই দেওয়াল লিখনটাও পড়তে ভুল হয়নি। তারপরেও দলবদলের লোভনীয় প্রস্তাব হাসতে হাসতে উপেক্ষা করেছেন।
নর্মদা রায়ের মতো মানুষেরা এ যুগে সত্যিই বেমানান। তাঁরা কখনই নিজের ঢাক নিজে পেটানোর বিদ্যে আয়ত্ব করতে পারেননি। তাই চিরকাল আড়ালেই থেকে গেলেন। নিঃশব্দেই হারিয়ে গেলেন। কলকাতার সবজান্তা মিডিয়া টেরও পেল না।