স্বরূপ গোস্বামী
জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কি বিধানচন্দ্র রায়ের কথা হত না? ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কি জ্যোতি বসুর কথা হত না? এমনকী আদবানি–বাজপেয়ীদের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও কথা হয়েছে। সবসময় যে প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রী একমত হয়েছে, এমনও নয়। কখনও কখনও চূড়ান্ত বিতর্কও হয়েছে। কিন্তু সেই কথোপকথন বেআব্রু হয়ে যায়নি। দৈনন্দিন কাগজের হেডলাইন হয়ে ওঠেনি। কারণ, দুপক্ষই ছিলেন শিক্ষিত, মার্জিত। তাঁরা জানতেন, প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয়। তাঁরা জানতেন, প্রশাসন চালাতে গেলে একটা শিষ্টাচার মানতে হয়। সব কথা প্রকাশ্যে আনতে নেই। এই কথোপকথন নিয়ে সস্তা নাটক বা গ্যালারি শো করতে নেই।
কিন্তু এই শিক্ষা বা শিষ্টাচার এখন একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। না প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে, না মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে। দুজনেই প্রবল গ্যালারি শো করতে ব্যস্ত। উনি দেখাতে চাইছেন, দেখো কেমন টাইট দিলাম। ইনি দেখাতে চাইছেন, দেখো, কীভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অপদস্থ করলাম। এই খেউড় নিয়ে মেতে থাকছে মলস্রোত মিডিয়া। কেউ ওই পক্ষের, কেউ নির্লজ্জভাবে এই পক্ষের। কেউ আর সাহস করে বলতে পারছে না, দু পক্ষই সমান অসভ্যতা করে চলেছেন।
ইদানীং একটা নতুন ব্যামো হয়েছে, ভিডিও কনফারেন্স। সবাই নাকি সবাইকে দেখতে পাবেন। প্রযুক্তির এই সুবিধাকে গ্রহণ করতে গিয়ে কতরকমের উটকো ঝামেলা যে তৈরি হয়েছে। একে অন্যকে দেখা কি খুব জরুরি? প্রধানমন্ত্রীর দাড়ি কতটা বড় হল বা কী রঙের পোশাক পরে আছেন, সেটা না দেখতে পেলে কি তাঁকে রাজ্যের সমস্যার কথা জানানো যায় না? তাছাড়া, সেই আলোচনা টিভির পর্দায় লাইভ এসে যাচ্ছে কেন? কাকে দেখাতে চাইছেন? নিজেদের আলোচনা নিজেদের মধ্যে রাখলেই তো হয়। পরে যেটুকু প্রিস ব্রিফিং দরকার, কোনও একজন দায়িত্বশীল আধিকারিক করলেই পারেন। তাতে নির্যাসটুকু উঠে আসতে পারে। গঠনমূলক দিকটা উঠে আসতে পারে। কিন্তু লাইভ টেলিকাস্ট হওয়ার ফলে দু’তরফেই গ্যালারি শো–এর প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। লোকদেখানো সস্তা নাটুকেপনা বেড়ে যাচ্ছে। যাঁকে সমস্যাটা জানানো দরকার, তাঁকে জানালে হয়ত সহজে মিটে যায়। কিন্তু তাঁকে জানানো যেন মূল লক্ষ্য নয়, আসল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে মিডিয়াকে জানানো, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করানো। ভাবতে অবাক লাগে, যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, যাঁরা রাজ্য চালাচ্ছেন, তাঁদের এই ন্যূনতম শিষ্টাচার ও সংবেদনশীলতাটুকু নেই।