গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তরই প্রায় কলকাতার লোকেদের হাতে। ক্যাবিনেটে জেলার তেমন প্রতিনিধিত্ব কই? অধিকাংশ জেলার ভাগে জুটেছে রাষ্ট্রমন্ত্রী, নয়তো গুরুত্বহীন দপ্তর। এরপরেও এই মন্ত্রিসভাকে কূপমণ্ডুক ক্যাবিনেট বলা যাবে না? লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।
ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনে আসছি। কূপমণ্ডুক। মানে, কুয়োর ব্যাঙ। ছোট বেলায় কথাটার মানে বুঝতাম না। কুয়োর ব্যাঙ বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে। পরে আস্তে আস্তে বুঝলাম, কুয়োর ব্যাঙ আসলে কুয়োকেই তার পৃথিবী মনে করে। কুয়োর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজও রাখে না।
রাজ্যের মন্ত্রিসভা দেখলে সেটাই বারবার মনে হয়। যেন কলকাতাটাই বাংলা। জেলাগুলোরও যে কোনও গুরুত্ব আছে, মন্ত্রিসভা দেখলে সেভাবে বোঝার উপায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো যেন কলকাতা ও আশপাশের দুই–তিন জেলার জন্যই বরাদ্দ। এবারও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।
উত্তরবঙ্গ থেকেই শুরু করা যাক। আলিপুরদুয়ার আর দার্জিলিং এই দুই জেলায় সব আসন বিজেপির। ফলে, মন্ত্রিসভায় কাউকে আনার সুযোগ ছিল না। বাকি বাকি জেলাগুলো কী দোষ করল? তারা কী দপ্তর পেল? কোচবিহার থেকে মন্ত্রী করা হল পরেশ অধিকারীকে, তাও পূর্ণমন্ত্রী নয়, রাষ্ট্রমন্ত্রী। যে পরেশ অধিকারী ২০০৬ সালে খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে পনেরো বছর পর রাষ্ট্রমন্ত্রী করা যায়? এটা সেই কলেজেরে প্রিন্সিপালকে প্রাইমারি স্কুলের প্যারা টিচার নিয়োগে মতোই হাস্যকর। কালিম্পংয়ে বিনয় মোর্চার প্রার্থী জিতলেও মন্ত্রিসভায় আনা হয়নি। জলপাইগুড়ি থেকেও মন্ত্রী নেই। দক্ষিণ দিনাজপুর থেকেও কোনও মন্ত্রী নেই। মালদায় এবার তৃণমূলের বেশ ভাল ফল হলেও জুটেছে সেই রাষ্ট্রমন্ত্রী (সাবিনা ইয়াসমিন)। উত্তর দিনাজপুরে গোলাম রব্বানি। দপ্তর সেই সংখ্যালঘু উন্নয়ন। মোদ্দা কথা, আট জেলা মিলিয়ে একজন মাত্র ক্যাবিনেট মন্ত্রী।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমের মতো দক্ষিণবঙ্গের জেলায় আসা যাক। পুরুলিয়ায় সন্ধ্যা টুডু, বাঁকুড়ায় জ্যোৎস্না মান্ডি, বীরভূমে চন্দ্রনাথ সিনহা। তিন জেলা মিলিয়ে একজন ক্যাবিনেটে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া মানেই যেন আদিবাসী জেলা। রাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া কিছুই তাদের বরাদ্দে জোটে না। অন্যান্য জেলাগুলিও একইরকম উপেক্ষিত। বেশিরভাগ জেলার ভাগে রাষ্ট্রমন্ত্রী আর গুরুত্বহীন দপ্তর ছাড়া বিশেষ কিছু জোটেনি।
কথায় কথায় জঙ্গল মহল আর উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের ফাঁপা গল্প শোনানো হয়। অথচ, মন্ত্রিসভায় চোখ বোলালেই বোঝা যায়, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জঙ্গলমহল বা উত্তরবঙ্গের গুরুত্ব কতখানি। এবার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দপ্তরে চোখ বোলানো যাক। স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, পঞ্চায়েত, পুর ও নগরোন্নয়ন, শিক্ষা, শিল্প, অর্থ, বিদ্যুৎ, কৃষি, ভূমি সংস্কার, তথ্য ও সংস্কৃতি, বন, পরিবহণ, আবাসন, দমকল, ক্রেতা সুরক্ষা, নারীকল্যাণ, যুবকল্যাণ, পরিষদীয়– এমন প্রায় সব দপ্তরই কলকাতার লোকেদের হাতে। কেউ কেউ সংলগ্ন জেলা থেকে নির্বাচিত হলেও তাঁদের বাড়ি সেই কলকাতাতেই। এমনকী পঞ্চায়েত, কৃষি, ভূমি সংস্কারের মতো গ্রাম নির্ভর দপ্তরগুলিও আলো করে বসে আছেন কলকাতার লোকেরাই।
এরপরেও এই মন্ত্রিসভাকে কূপমণ্ডুক বলা যাবে না? যত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই আসুক, বাংলা সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতা ও উপেক্ষা না থাকলে এমন মন্ত্রিসভা গড়া যায় না।