(কয়েক বছর আগের কথা। হঠাৎ করেই পৌঁছে যাওয়া তেনজিং নোরগের বাড়িতে। যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। এভারেস্ট দিবসে (২৯ মে) সেই স্মৃতিই উঠে এল বেঙ্গল টাইমসে)।
স্বরূপ গোস্বামী
ম্যাল থেকে সোজা চলে গেছে একটা রাস্তা। কখনও একটু চড়াই, কখনও আবার ঢালু। এদিকটায় পর্যটকের তেমন ভিড় নেই। একে তাকে জিজ্ঞেস করে সোজা পৌঁছে যেতে পারেন ওই জোড়া সাদা বাড়ির কাছাকাছি। রাস্তা থেকে উঠে গেছে সিমেন্টের সিঁড়ি। দুপাশে দুই বাড়ি। বাড়ি না বলে ইমারত বলাই ভাল। স্বাগত জানানোর জন্য বাইরেই ছাড়া আছে তিনটি বিদেশি কুকুর। তাদের আহ্বান শুনে শুরুতেই ভয় পেয়ে যেতেই পারেন। মনে হতে পারে, আর ওপরে উঠে কাজ নেই। ফিরে যাওয়াই ভাল। কিন্তু কুকুরের ভয় কাটিয়ে যদি ওপরে উঠে যান, এক জীবন্ত ইতিহাস অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য।
হ্যাঁ, এখানেই তেনজিং নোরগের বাড়ি। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়া সেই তেনজিং। প্রথম এভারেস্টে পা রাখা সেই তেনজিং। শুধুই কি পাহাড়ে ওঠা! আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও যে একটা মিথ হয়ে গেঁথে আছে নামটা। অনেক ডাকাডাকির পর বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। কিছুই বুঝলেন না। তিনি কী বলতে চাইলেন, তাও বোঝা গেল না। ডেকে আনলেন আরেকজনকে। মাঝবয়সী, বেশ সুঠাম চেহারা। হ্যাঁ, ইনিই তেনজিং পুত্র জামলিং। তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে একমাত্র জামলিংই রয়েছেন দার্জিলিংয়ে। বড় ভাই নোরবু থাকেন ক্যালিফর্নিয়ায়। বিয়ের পর বোন ডেকিও ক্যালিফর্নিয়ায়। ছোট ভাই ডামে থাকেন দিল্লিতে। জামলিংয়েরও পড়াশোনা আমেরিকায়। কিন্তু ফিরে এসে দার্জিলিংয়েই পাকাপাকি বসবাস। বাকি দুই ভাই চুটিয়ে ব্যবসা করলেও জামলিং বেছে নিয়েছেন বাবার পথকেই। বাবা তেনজিং যখন এভারেস্টে পা রাখেন তখন জন্মও হয়নি জামলিংয়ের। কিন্তু ছোট থেকেই শুনে আসছেন বাবার ওই অসামান্য কীর্তির কথা। তাই ঠিক করলেন, আমিও পাহাড়ে উঠব। একটু বড় হতেই বাবার সঙ্গ নিলেন। কাছে পিঠে বেশ কিছু পাহাড়ে চড়ার হাতেখড়িও হয়ে গেল। পড়াশোনার সূত্রে যেতে হল আমেরিকায়। সেখানেই পেলেন বাবার মৃত্যু সংবাদ। ফিরে এসে আবার পাকাপাকি পর্বতারোহনে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল স্বপ্নটা, বাবার মতো আমাকেও একদিন এভারেস্টে উঠতে হবে। প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেল। স্বপ্নটা সফল হল ১৯৯৬–এ। দেওয়াল জুড়ে সেই ছবি। ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ ভিজে এল জামলিংয়ের, ‘বাবার ইচ্ছেপূরণ হল। কিন্তু উনি দেখে যেতে পারলেন না। ওই ছবিটা দেখলে সবথেকে খুশি হতেন ওই মানুষটাই।’
একেবারে কর্পোরেট কায়দায়, দারুণভাবে ঘরটা সাজিয়েছেন জামলিং। দেওয়ালের নানা প্রান্তে টাঙানো তেনজিংয়ের ছবিতে জীবন্ত হয়ে উঠছে মুহূর্তগুলো। সযত্নে সাজানো তেনজিংয়ের দুই আত্মজীবনী ‘টাইগার অফ দ্য স্নো’, ‘তেনজিং আফটার এভারেস্ট’। পাশের একটা বিশাল হলঘরে সাজানো স্মারক। কম্পিউটারের নানা ফোল্ডারেও নানা মুহূর্তের তেনজিং। এই বাড়িতেই কতবার এসেছেন নেহরু, ইন্দিরা। বারবার ঘুরে গেছেন এডমন্ড হিলারিও। অনেক সুখস্মৃতি ভিড় করে আসছে। তার মধ্যে রয়ে গেছে চাপা অভিমানও, ‘বাবার স্বপ্নের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট দেখে কষ্টই হয়। নেহরুজির স্বপ্ন ছিল, ওখান থেকে আরও হাজার তেনজিং বেরিয়ে আসুক। বাবাও তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন যাঁরা চালাচ্ছেন, তারা হয়ত তা চাইছেন না। দায়সারা ভাবে একটা এভারেস্ট ডে–র অনুষ্ঠান। এতেই যেন ওদের দায়িত্ব শেষ।’ নিজেও পর্বতারোহনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। কখনও নেপাল, কখনও সিকিমে গিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এইচ এম আইয়ে ব্রাত্য। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘আর্মির লোকজন তাদের মতো করে চালাচ্ছেন। আমিও এভারেস্টে উঠেছি। আমিও পর্বতারোহনের কিছু তো বুঝি। ওরা যে কায়দায় শেখাচ্ছে, ওভাবে পর্বতারোহী তৈরি হয় না। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। শেরপাদের কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয় না। এমনটা তো বাবা চাননি। বেঁচে থাকলে, এই অবস্থা দেখলে কষ্টই পেতেন।’
উঠে এল আরও অভিমান, ‘আগে তো টেক্সট বইয়ে বাবার জীবনী পড়ানো হত। ফলে, বাচ্চারা জানতে পারত। এখন তাও হয় না। এত মানুষকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়। যে মানুষটা সারা বিশ্বের কাছে ভারতের পতাকাকে তুলে ধরল, তাকে মরণোত্তর ভারতরত্নও দেওয়া যায় না! তবু শিলিগুড়ির মানুষ কিছুটা মনে রেখেছে। ওখানে বাবার মূর্তি আছে, বাবার নামে বাস টার্মিনাসও আছে।’ কথা হতে হতেই খুনসুটি করতে করতে ঘরে ঢুকল দুই যমজ বোন ডেচেন, পেলজন। এসেই কম্পিউটার নিয়ে কাড়াকাড়ি। জামলিং ওদের মৃদু ধমক দিয়ে বেশ গর্বের হাসি হেসে বললেন, ‘ওরা সব সময় দাদুর কথা জানতে চায়। ওদেরও পাহাড়ে চড়ার খুব আগ্রহ। আশেপাশে অনেক ছোট পাহাড়ে উঠেছে। দুজনেই খুব সাহসী। দেখবেন, একদিন ওরাও এভারেস্টে উঠবে। এভাবেই ওরা দাদুকে শ্রদ্ধা জানাতে চায়।’ চোখ ছলছল করে উঠল তেনজিং পুত্রের। দুই মেয়ে তখন বাবার দিকে তাকিয়ে। চোখ গেল দেওয়ালে টাঙানো বরফমোড়া ওই এভারেস্টে। ওদেরকেও যে একদিন ওই শিখরে পৌঁছতে হবে!