রক্তিম মিত্র
আবার সেই অডিও ফাঁস। আবার বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী।
এবার অবশ্য বিরোধী দলের নেতাকে নয়, ফোন করলেন নিজের দলের জেলা সভাপতিকে। তিনিই আবার শীতলকুচির প্রার্থী।
তৃণমূল নেত্রী নিজের প্রার্থীকে ফোন করবেন, এর মধ্যে আশ্চর্যের কী আছে? বিতর্কেরই বা কী আছে? কিন্তু যা বলেছেন, তা মারাত্মক। কেউ কেউ যথারীতি বলবেন, ফেক ভিডিও। চ্যানেলগুলি যথারীতি বলতে শুরু করেছে, ভিডিওর সত্যতা আমরা যাচাই করিনি। এগুলো আসলে গা বাঁচানো কথা। কথাগুলো যে মুখ্যমন্ত্রীর, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কণ্ঠস্বরটা তাঁর। বলার ভঙ্গিটা তাঁর মতোই। এমন একটি কথাও বলা হয়নি, যেটা তিনি বলতে পারেন না। তিনি তো এই জাতীয় কথাই বলে থাকেন।
কী মারাত্মক কথা! বডিগুলো কবর দিও না। ফ্যামিলিকে বোলো, বডি যেন না নেয়। ওগুলো নিয়ে কাল র্যালি হবে।
তারপরই বললেন, আরও মারাত্মক কথা। নিজে নিজে এফআইআর করতে যেও না। ল–ইয়ারের সঙ্গে আলোচনা করে এফআইআর করতে হবে। কী করতে হবে, আমি বলে দেব। ফ্যামিলিকে দিয়ে সেইভাবে এফআইআর করতে হবে। যেন এসপি কে ফাঁসানো যায়। যেন আইসিকে ফাঁসানো যায়।
আবার বলছি, যে যতই অস্বীকার করুক, কণ্ঠস্বরটা যে মমতা ব্যানার্জির, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তৃণমূলের লোকেদেরও সন্দেহ নেই। স্বীকার করতে পারছেন না, এই যা। তাই মিথ্যাচার করে যেতে হচ্ছে।
কী মারাত্মক কথা! ভোটের সময় ডেডবডি নিয়ে মিছিল? এতে তো দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত। তিনি কি জওয়ানদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে খেপিয়ে তুলতে চান? একজন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন এসপি–কে ফাঁসাতে হবে! আইসি–কে ফাঁসাতে হবে! নিজের প্রশাসনকে কিনা ফাঁসাতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এটা নিছক একটা অডিও নয়। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। এমন অসংখ্য কথোপকথনের একটি নমুনা মাত্র। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি এভাবেই দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দেন। তিনি এভাবেই প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। বিরোধীদের নামে কেন এত ভুরি ভুরি মিথ্যে মামলা, এর থেকে কিছুটা বোঝা যায়। কোনওটা নেত্রীর নির্দেশেই হয়। আবার কোনওটা হয়ত নির্দেশ দিতে হয় না। পারিষদরা নেত্রীকে খুশি করতে নিজেদের উদ্যোগেই মিথ্যে মামলা দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন হল, কীভাবে ফাঁস হল? অভিযোগ উঠবে, কেন্দ্র থেকে ফোন ট্যাপ হয়। হলেও হতে পারে। কেন্দ্রে যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন, তাঁদেরকেও এত সাধু পুরুষ ভাবার কোনও কারণ নেই। তাঁরা যে বিশ্বাসযোগ্য নন, এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ তাঁরা নিজেরাই রোজ রেখে যান।
কিন্তু ট্যাপ না হলেও এই কথোপকথন বাইরে আসতেই পারে। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয় ফাঁস করবেন না। কিন্তু যাঁকে ফোন করা হয়েছিল, সেই পার্থপ্রতিম রায়ও ইচ্ছে করে ফাঁস করবেন না। কিন্তু যেভাবে হ্যাঁ দিদি, হ্যাঁ দিদি করে গদগদ হয়ে কথা বলে গেলেন, তাতে বোঝাই যায়, মুখ্যমন্ত্রী ফোন করায় তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত। মুখ্যমন্ত্রী ফোন করেছেন, এতবড় একটা ব্যাপার তাঁর পক্ষে গোপন রাখা সম্ভব? নিজের দর বাড়াতে একে তাকে শোনাতেই হবে। না শোনালে পেট গুড়গুড় করবে। যাঁরা সামনে আছেন, তাঁদের না হয় মোবাইল থেকে শোনানো হল। কিন্তু যাঁরা দূরে আছেন, তাঁদের কাছে লিঙ্ক পাঠানোটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তেমনই কারও কাছ থেকে ফাঁস হয়ে থাকতে পারে। মোদ্দা কথা, ফাঁসের বড় উৎস হতে পারে প্রার্থীর মোবাইল। সেটা পরীক্ষা করলেই জানা যায়। এর জন্য সিবিআই তদন্তেরও দরকার নেই। রাজ্য পুলিশই অনায়াসে বলতে পারে, প্রার্থীর ফোন থেকে কার কার ফোনে ওই লিঙ্ক গেছে।
মোদ্দা কথা হল, কেন্দ্র বা বিজেপি ট্যাপ না করলেও মুখ্যমন্ত্রীর এই ফোনাফুনি ফাঁস হওয়ার অনেক কারণ একেবারে স্থানীয়স্তরেই থেকে গেছে। তবু হাওয়া গরম করতে হবে। কেন্দ্রের চক্রান্ত বলে চিৎকার করতে হবে। নন্দীগ্রামে সামান্য একটা দুর্ঘটনাকে কীভাবে চক্রান্তের তকমা দেওয়ার চেষ্টা হল। একজনের মিথ্যে ঢাকতে কতজনকে ক্রমাগত মিথ্যে বলে যেতে হল! এবার এই অডিও নিয়েও সেই ট্র্যাডিশনই চলবে।