অপর্ণা সেন বললেই মনে হয় সুন্দরী এক নায়িকা। কিন্তু পরিচালক অপর্ণা ? সেইদিকেই আলো ফেলা হল এই প্রতিবেদনে। বিশেষভাবে উঠে এল পরমা-র কথা। যা সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ছবি। এই সুরই উঠে এল স্নেহা বিশ্বাসের লেখায়।
ছবিটি যখন মুক্তি পায়, আমার বয়স চার বছর। সিনেমা বোঝার মতো বা অপর্ণা সেনকে চেনার মতো বয়স নয়। পরমা ছবিটি প্রথম দেখলাম নয়ের দশকের মাঝামাঝি। ততদিনে ‘রক্ষণশীল’ দূরদর্শনের নির্ভরতা ছেড়ে বাঙালি একটু একটু করে স্যাটেলাইট চ্যানেলমুখী হচ্ছে। একটু একটু করে চিন্তা-চেতনার দরজা জানালাগুলো খুলে যাচ্ছে।
তখনই একদিন টিভিতে দেখলাম পরমা। তার আগে ছবিটি নিয়ে শুধু খারাপ খারাপ কথাই শুনে এসেছি। বলা হত, ছবিটি খুব খারাপ। মেয়েদের অপমান করা হয়েছে। এই ছবি দেখলে মেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে।
কী জানি, হয়ত সেই কারণেই ছবিটি দেখার ইচ্ছে আরও বেড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, কী খারাপ আছে, একবার নিজের চোখেই দেখা দরকার। একটা ছবির ক্ষমতা নেই কাউকে উচ্ছন্নে পাঠানোর। যে উচ্ছন্নে যাওয়ার সে এমনিতেই যাবে।
ছবিটি দেখার পর টানা কয়েকদিন ওটা নিয়েই বারবার ভেবেছি। সত্যিই যদি আমাদের বাড়ির মা-কাকিমারা এমন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, মেনে নিতে পারব তো ? আবার পরমার জায়গায় যখন নিজেকে বসিয়েছি, তখন মনে হয়েছে, একজন নারীকে কি সবসময় পুরুষের মন জুগিয়েই চলতে হবে ? তার কি নিজের স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই ?
তখন থেকেই অপর্ণা সেন আমার কাছে আরও বেশি শ্রদ্ধার পাত্রী হলেন। ভেবে দেখুন, আজ থেকে ৩২ বছর আগে এমন একটা বিষয় নিয়ে ছবি বানানো হয়েছিল ? তাও কিনা একজন মহিলা বানিয়েছিলেন ? কোনও মেইনস্ট্রিম পুরুষ পরিচালকের এতখানি সাহস হত কিনা জানি না।
অপর্ণা সেনের ভাবনা সত্যিই সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। বাংলায় অনেক বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু এখানেই তাঁদের সঙ্গে অপর্ণার ফারাক। তিনি শুধু অভিনেত্রী নন। তাঁর পড়াশোনা, তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়, তাঁর সমাজমনস্কতা, দূরদর্শিতা – এসব তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে। তাই বাংলায় অনেক অভিনেত্রী এলেও সেভাবে কাউকে পরিচালনায় আসতে দেখা যায়নি ( শতাব্দী রায় দু-একটা ছবি করেছেন ঠিকই। কিন্তু সেগুলো মোটেই পাতে দেওয়ার মতো নয়। ওই রকম বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে যে মানের ছবি হয়, সেটাই হয়েছে)।
পরেও তাঁর পরিচালনায় বেশ কিছু ছবি দেখেছি। দাগ কেটেছে পারমিতার একদিন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার, ইতি মৃণালিনী। একেবারেই ভাল লাগেনি এমন ছবির কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব গয়নার বাক্স, আরশিনগর। মনে হয়েছে, এগুলো তিনি না বানালেই পারতেন।
একজন পরিচালকের সব ছবি ভাল লাগবেই, এমনটা না হওয়াই স্বাভাবিক। ভবিষ্যতে যদি একটি ছবির জন্যই তাঁকে মনে রাখতে হয়, তবে তা হল পরমা। সত্যিই ছবিটা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। আমাদের চিন্তা চেতনাকে অনেকটা সাবালক করে তুলেছিল।