সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
সেই ছোটবেলায় স্কুলের গরমের ছুটির সময়ে কলকাতা দূরদর্শনে “ছুটি ছুটি” অনুষ্ঠানে প্রথমবার দেখেছিলাম “বাড়ি থেকে পালিয়ে” সিনেমাটা । খুব যে ভাল লেগেছিল, এমনটা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। কিন্তু যেটা সত্যি সেটা হল, সিনেমাটা দেখার পরে মনে মনে ইচ্ছে জেগেছিল, যদি আমিও ওরকম বাড়ি থেকে চুপিচুপি পালিয়ে কলকাতায় চলে যাই। যেমন “গুপী গাইন বাঘা বাইন” দেখে মনে হয়েছিল, যদি ভূতের রাজা আমাকেও ওইরকম তিনটে বর দিত তাহলে কী দারুণ হত! যাই হোক, হয়তো ছোটদের ছবি বলেই এগুলো দেখার পরেই ভাবিয়ে তোলে শিশুমনকে। কিন্তু ছোটদের সব ছবিই কি এরকম ভাবাতে পারে? বোধহয় না। এখানেই একজন চলচ্চিত্রকারের মুনশিয়ানা। যে বয়সে মানুষ রুপকথা বা রামায়ণ মহাভারত বা ঠাকুরমার ঝুলিতে মজ়ে থাকে, সেই বয়সের উপযোগী সিনেমা বানানো এবং শিশুমনে প্রভাব বিস্তার করা। “বাড়ি থেকে পালিয়ে” র শেষে কোলকাতা শহরে পালিয়ে এসে থাকা কতটা কঠিন, ইঁট-কাঠ-পাথরের পাঁজরে কত মর্মব্যথা সেখানে লুকিয়ে আছে, তা দেখিয়েছিলেন পরিচালক। বোঝাতে চেয়েছিলেন বাড়ি থেকে পালানো সোজা, কিন্তু ওই বয়সে অচেনা জগতে গিয়ে টিকে থাকা একজন কিশোরের পক্ষে খুবই কঠিন। ছবির শেষের দিকে একজন মুটেকে দিয়ে সেই কথাই বলিয়েছিলেন পরিচালক। “এ লড়াইয়ের জায়গা- কলকাতা শহর- দয়া মায়া কিছু নেই। যা ঘরে চলে যা”। পরবর্তীকালে সিনেমা বোঝার মতো পরিণত বয়সে এসে “অযান্ত্রিক”, “মেঘে ঢাকা তারা”,”সুবর্ণরেখা” ইত্যাদি সব সিনেমাগুলো দেখে বুঝেছিলাম সিনেমা শুধু নিছক বিনোদন বা বাণিজ্যিক মাধ্যম নয়। তার বার্তা, তার ভাষা কত গভীর, তার আবেদন কতখানি মর্মস্পর্শী। বিশেষত দেশভাগের অব্যক্ত যন্ত্রণা যাদের প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খায়, সেই অতি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে সিনেমা বানানো—এ মনে হয় ঋত্বিক ঘটকের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিত এবং মহত্তম বোদ্ধা বলেই সম্ভব।
আসলে কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা বিভিন্ন সৃষ্টিশীল জগতে আসেন উল্কার মতো। সবকিছু গতানুগতিক বা জগদ্দল পাষাণের মতো যা কিছু, তাকে ভেঙে চুরে তছনছ করে আবার হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান। ফুটবলের রাজপুত্র দিয়োগো মারাদোনার কথাই ধরা যাক। মাঠের বাইরে এত বিতর্কিত খেলোয়াড় সারা বিশ্বে খুব কমই এসেছেন। কিন্তু মাঠের মধ্যে তাঁর বাঁ পায়ের সেই শৈল্পিক সত্তা ? যতদিন ফুটবল খেলা থাকবে, মারাদোনা পূজিত হবেন প্রজম্নের পর প্রজম্নের কাছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে ঋত্বিক ঘটকও ঠিক তেমনই। কোনও গণ্ডীর মধ্যে তাঁকে বাঁধা অসম্ভব। তিনি সময়ের দাবি মেনে সিনেমা করেননি, নামজাদা নায়ক বা নায়িকাদের নিয়ে সিনেমা বানাননি বাণিজ্যিক লাভের জন্য, প্রযোজকদের পাত্তা দেননি, বরং “ব্যবসাদার” বলে খেদিয়ে দিয়েছেন বহুবার। এমনকি এও বলেছেন যেদিন ফিল্ম মেকিং এর থেকে ভাল কোনো মিডিয়াম পাবেন সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা গুলোকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার, সেদিন সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাবেন। এমনই খামখেয়ালী,বাউণ্ডুলে তাঁর ব্যক্তিসত্তা। আর তাই জীবদ্দশায় মাত্র আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা বানাতে পেরেছিলেন। অধিকাংশ সিনেমাই বোঝার মতো দর্শক এই দুর্ভাগা দেশে তখন ছিল না (এখনও কি আছে!)। বাংলার “ম্লান-মূঢ়-মূক” জনতা গ্ল্যামারাস উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন বা সাদা কালো দিলীপ কুমার-মধুবালা বা রাজকাপুর-নার্গিসেই আসক্ত ছিল। আর্থিক ক্ষতি কম হয়নি ঋত্বিক ঘটকের। পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা ছাড়া বানিয়েছিলেন কয়েকটা মূল্যবান ডকুমেন্টরি। সেখানেও সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা, রাজনৈতিক বার্তাই দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে মাত্রতিরিক্ত পানাসক্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বেশ কিছুকাল মানসিক চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। মাত্র ৫১ বছর বয়সেই দপ করে নিভে গিয়েছিল সেই প্রজ্জ্বলিত আগুনটা, যা তাঁর প্রয়াণের বেশ কিছু বছর পর থেকে আজও জ্বলছে অনির্বাণ দীপ্তি নিয়ে। দুর্ভাগা দেশে ঋত্বিক ঘটকের মতো প্রতিভার মুল্যায়ন হচ্ছে অবশেষে!
প্রায় একই সময়ে এসেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের তিনজন মহত্তম স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন। বাংলা চলাচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে উন্নীত করার সার্থক রূপকার তাঁরাই। ঋত্বিক কিন্তু বরাবরই ব্যতিক্রমী। তাঁর সিনেমা কোনও সাধারণ পুতু-পুতু মার্কা প্রেমের গল্প বা বিরহের কাহিনী বা সম্পর্কের টানাপোড়েন নয়। প্রতি মুহূর্তে তিনি দর্শককে ধাক্কা দিয়ে বুঝিয়েছেন “It’s not an imaginary story”। ঋত্বিক ঘটক কোনও দর্শককে সস্তা আনন্দ দিতে আসেননি। বরং প্রতি মুহূর্তে Hammer করে বোঝাতে চেয়েছেন যে যা দেখছেন, তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যে বার্তা টা দিতে চেয়েছেন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই প্রতি মুহূর্তে alienate করে গেছেন। তাঁর সার্থক উপলব্ধি ছিল Involvement হল শিল্পীর কিন্তু alienation সবসময়ই audience এর। “অযান্ত্রিক” এর জগদ্দল গাড়ির ড্রাইভার বিমলের তাঁর জীবনসাথী জগদ্দলের প্রতি হৃদয়ের টান বা “নাগরিক” ছবিতে চাকরি–প্রত্যাশী সেই ছেলেটির চরিত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাংলার মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণার এক বস্তুনিষ্ঠ শিল্পরূপ। বার বার ইন্টারভিউতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসার মাধ্যমে একসময় ছেলেটির ধারণা হয়ে গেল There is no good turn to wait for him. এখানেই তিনি Hammering করে বোঝাতে চেয়েছিলেন আমাদের এই সামাজিক কাঠামোয় যারা মধ্যবিত্ত তারা চিরকালই অর্থনৈতিক দিক থেকে একই জায়গায় থেকে যাবে, কোনওদিন ওপরে উঠতে পারবে না। আজও কত প্রাসঙ্গিক এই উপলব্ধি!
নিজেই বলেছিলেন যে তিনি সিনেমার ভাষা শিখেছিলেন আইজেনস্টাইনের কাছে। আবার একথাও বলেছেন আইজেনস্টাইনের দ্বারা প্রভাবিত নন। বরং তাঁর বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল তীব্র সমাজ সমালোচক লুইস বুনুয়েল। তা ছাড়া জাপানী চলচ্চিত্রকার মিজোগুচি এবং কুরোসাওয়া,ইটালির ফেলিনি এবন মেক্সিকোর ভ্লাদিমির নেশন ও তাঁর মতে অনন্য। বার্গম্যানকে যেমন “জোচ্চোর” বলতে ছাড়েননি, তেমনি The Bicycle Thief এর অমর স্রষ্টা ভিট্টোরিও ডি সিকাকেও শেষের দিকের বিচারে শিথিল,টেনে হিঁচড়ে চলা বলতে বাকি রাখেননি। আর ভারতীয় চলচ্চিত্রকার দের মধ্যে নিউ থিয়েটার্সের প্রাণপুরুষ প্রমথেশ বড়ুয়া তাঁর বিচারে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক। তবে “পথের পাঁচালী” তাঁকে এতটাই স্পর্শ করেছিল যে একথা নিজমুখেই বলে গিয়েছিলেন “আমি মনে করি ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের মাধ্যমটাকে যদি কেউ সঠিকভাবে বুঝতে পেরে থাকেন তো তিনি সত্যজিৎ রায়”। সমধারার ছায়াছবির বাইরে কিছু সৃষ্টিশীল কাজের জন্য মৃণাল সেনকেও তিনি দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
তাঁকে সবচেয়ে পীড়িত করেছিল দেশভাগ। বাংলাদেশ ভাগ হয়ে যাওয়াটা তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি। নিজে বহু জায়গায় বলেছিলেন সে কথা। “আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনকে তোলপাড় করে তুলেছিল। আজ়কের সমস্ত অর্থনীতিটা যে চুরমার হয়ে গেছে তার Basic Factor ছিল ওই বাংলাভাগ। ছিন্নমূল বাঙালির ভিটে মাটি থেকে উৎখাত হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে এপারে ফিরে আসার মর্মান্তিক দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেননি। “মেঘে ঢাকা তারা”, “কোমল গান্ধার” এবং “সুবর্ণরেখা” এই তিনটে ছবিতে তিনি দেশভাগের অব্যক্ত যন্ত্রণার কথাটাই প্রকাশ করেছিলেন। সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ ছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। তাই অদ্বৈত মল্লবর্মণের “তিতাস একটি নদীর নাম” কাহিনীকে ছায়াছবিতে রূপান্তরিত করার সময়ে তিনি কাহিনী অনুযায়ী তিতাস নদী নিশ্চিহ্ন এবং নদীর ধারে জেলেদের সমাজটা চুরমার হওয়া সত্ত্বেও ছায়াছবির শেষে দেখিয়েছিলেন শস্যশ্যামল ধানের ক্ষেত। ঋত্বিক ঘটকের বক্তব্য ছিল, একটা সভ্যতা শেষ হয়ে যাওয়াটাই শেষ নয়। তার মৃত্যুর মধ্যেও উপ্ত আছে নতুন সভ্যতার বীজ। রবি ঠাকুরের ভাষায় যেমন “তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ ওঠে/ কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে”। নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ..
আসলে মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন পাগলের মত। মানুষের জন্যি তাঁর ছবি নির্মাণ। মানুষ ছাড়া আর কিছুই নেই। তার বিচারে সর্বশিল্পের শেষ কথা হল মানুষ। মানুষের ভাল করতে না পারলে তাঁর বিচারে কোনও শিল্পই দাঁড়ায় না । তাই “মেঘে ঢাকা তারা” অন্তিম দৃশ্যে নীতার মুখেও সেই করুণ অথচ সৃষ্টিশীল আর্তি। “দাদা আমি বাঁচতে চাই”। “অযান্ত্রিক” এর বিমল জগদ্দলকে নিয়েই স্বপ্ন দেখে, “নাগরিক” এর সেই বেকার তরুণ তার প্রেমিকাকে বিয়ে করেই কঠিন জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং তিতাস নদী শুকিয়ে যাওয়ার পরেও তার তীরে নতুন সভ্যতার শুরু। ঋত্বিকের কাছে মানুষ মরণশীল কিন্তু মানবসভ্যতা অজয়, অমর, অক্ষয়।
সারা জীবনে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অফুরন্ত। কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফোরাম I.P.TA. এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। মার্ক্সের নীতি তাঁর জীবনদর্শনের মূল চালিকাশক্তি। মার্ক্সের ওপরে বেশ কয়েকটা ম্যাগাজিন ও বের করেছিলেন সিনেমা বানানোর আগে। তখন I.P.TA এর হয়ে নাটক, পথসভা করতেন বিজন ভট্টাচার্য,উৎপল দত্ত,সলিল চৌধুরিদের সঙ্গে। লেনিনের শতবর্ষে “আমার লেনিন” একটি ডকুমেন্টরি বানিয়েছিলেন। শোষণমুক্ত, শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন ঋত্বিক। সোভিয়েত রাশিয়া তাঁর আদর্শ ছিল। নকশাল দের প্রতি একটা অন্যধরণের দুর্বলতা ছিল। তিনি মনে করতেন, সমাজটাকে ওরাই ভেঙে নতুন করে গড়বে। তাই সামাজিক শোষণ এবং অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকে। যদিও শিল্পী হিসেবে Slogan Mongering এ বিশ্বাসী ছিলেন না। এর পাশাপাশি পুণা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে অধ্যাপনাও করেছিলেন দীর্ঘদিন। অদ্ভূত আনন্দ পেয়েছিলেন মণি কাউল, কুমার সাহানি, কে.টি. জ়ন এর মতো কৃতী ছাত্রদের ফিল্ম লাইনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে। বলেও ছিলেন সে কথা। দাঁড়িপাল্লার দু-দিকে সিনেমা বানানো আর অধ্যাপনা রাখলে অধ্যাপনার ওজনই বেশি হবে।
জীবনের সায়াহ্নে এসে সর্বশেষ সৃষ্টি “যুক্তি-তক্কো আর গপ্প” তে নীলকণ্ঠ বাগচীর সেই অনন্যসাধারণ অভিনয় এবং মুখে তাঁর পরম অগ্রজ রবীন্দ্রগানের প্রবাদপ্রতিম কন্ঠ দেবব্রত বিশ্বাসের “কেন চেয়ে আছো গো মা মুখপানে” –এক বিদগ্ধ,মহত্তম শিল্পস্রষ্টার জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ১৯৭০-১৯৭২ এই দু বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করে যে জীবনপ্রবাহ তিনি দেখেছিলেন তাকে সুতীব্র আক্রমণ করাই ছিল এই ছায়াছবির লক্ষ্য। যা ঘটছে, তাকে ঘটতে দেওয়া যায় না। এ অন্যায়, এ মহাপাপ ।
আর তার পরেই মাত্র ৫১ বছর বয়সে পানাসক্ত এক প্রোটাগনিস্ট দের মহাপ্রস্থান। যা কিছু অন্যায়, অবিচার থেকে ধাক্কা দিয়ে, অচলায়তনকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে, আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচিয়ে এবং আঁতেলদের “ভাবা প্র্যাকটিস করিয়ে”। তাঁর পাগলামি, নেশা, খামখেয়ালিপনা থেকে সৃষ্টি, এমনকি ঝরে পড়া– কোনও কিছুরই কোনও তুলনা নেই।
ঋত্বিকের তুলনা তো ঋত্বিক নিজেই !