ময়ূখ নস্কর
আমাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয় না মশাই! কেউ সিরিয়াসলি নেয় না!
মানছি, আমি আক্ষরিক অর্থেই একজন কাগুজে মানুষ। বইয়ের পাতার বাইরে আমার কোনও অস্তিত্বই নেই। হ্যাঁ, সিনেমা বা টিভির পর্দায় আমাকে দেখা গেছে ঠিকই, কিন্তু বইয়ের কাগজই হল আমার জন্মভুমি এবং কর্মভূমি! কিন্তু এমন চরিত্র তো কতই আছে। গোরা, অপু, অমল, শ্রীকান্ত। এদের তো কেউ সামান্য সাহিত্যিক চরিত্র বলে হেলাফেলা করে না?
এদের সৃষ্টি কেন হল? এদের মাধ্যমে স্রষ্টা কী বার্তা দিতে চাইলেন, এরা কি আসলে স্রষ্টারই প্রতিরূপ, ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচা হয়।
তাহলে মশাই আমার বেলায় এত কার্পণ্য কেন? এই যে ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কু? এঁরা যে সত্যজিৎ রায়েরই চরিত্রের দুটো দিক, তা তো সবাই জেনে গেল। তাহলে আমি কার চরিত্রের কোন দিক, সেটা কেউ জানল না কেন? কেন কেউ ভাবে না আমাকে সত্যজিৎ রায় সৃষ্টি করলেন কেন?
ফেলুদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা যোধপুর যাবার পথে ট্রেনে। আমাকে দেখেই তপেশের ‘যাকে বলে পেট থেকে ভসভসিয়ে সোডার মতো হাসি গলা অবধি’ উঠে এসেছিল। কেউ ভাবল না, এত উপমা থাকতে হাসির সঙ্গে সোডার উপমা কেন এল? ভাবুন।
তারপরে ভাবুন, সোনার কেল্লায় জানা গেল, আমি ভদ্রেশ্বরে থাকি। কিন্তু পরের থেকেই আমার বাড়ি হয়ে গেল কলকাতার গড়পারে। কেন? ভদ্রেশ্বরের ভুল তিনি শুধরে নিলেন কেন? এত জায়গা থাকতে গড়পারেই বা কেন? গড়পারে আমি ছাড়া আর কার বাড়ি ছিল? ভাবুন।
এবার সিনেমাটার কথা ভাবুন। আমি ফেলুবাবুর শরীরের মাপ জানতে চাইছি। উত্তরে ফেলুবাবু বললেন, তাঁর ছাতি, কোমর সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি। আমি অট্টহাস্য করে বললাম, ‘আপনি কি শুয়োর?’
আরও ভাবুন, মন্দার বোসকে হাতেনাতে ধরে ফেলার পর ফেলুবাবু বললেন, ‘আপনার কী শাস্তি হবে জানেন তো? তিন মাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি।’
সোনার কেল্লা থেকে বেরিয়ে আসুন। এবার জয় বাবা ফেলুনাথ। কাশীর আধো অন্ধকার থমথমে গলিতে হাঁটছি আমি, ফেলুবাবু আর তপসে। ফেলুবাবু কবিতা আওড়াচ্ছেন, “অলি গলি চলি রাম…।” আমি বললাম, এই পুরানো বাড়িগুলো haunted, কড়িকাঠ থেকে বাদুড় ঝুলছে। বাদুড় শুনে ফেলুবাবু বললেন, ‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই শজারু, আজ রাতে দেখবে একটা মজারু।’ চরম টানটান মুহূর্ত, একটু পরেই একটা খুন হবে। এমন সিরিয়াস জায়গায় এমন হাস্যরস আর কেউ কখনও সৃষ্টি করেছেন কি?
করেছিলেন। অকালমৃত্যুর আগে জীবনের শেষ কবিতায় এক বাঙালি কবি লিখেছিলেন—
আজকে দাদা যাওয়ার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক
নাই বা বুঝুক বেবাক লোক
…………………………………
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।
হ্যাঙলা হাতি চ্যাংদোলা
শুন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা।
…………………………………….
আদিম কালের চাদিম হিম,
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর।
সেই কবিরও বাড়ি ছিল গড়পারে। ‘সোডার মতো হাসি,’ ‘আপনি কি শুয়োর?’ ‘তিন মাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি,’ ‘অলি গলি চলি রাম…,’ ‘বাদুড় বলে ওরে ও ভাই শজারু…’, এসব আসলে তাঁরই সৃষ্টি।
শৈশবে হারিয়ে ফেলা সেই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই কি সত্যজিৎ আমাকে সৃষ্টি করেছিলেন? যে কারণে তাঁর ছড়ার বইয়ের নাম ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম,’ গল্পের নাম ‘প্রফেসর হিজিবিজবিজ’ সেই একই কারণেই কি আমার মতো একটি চরিত্র সৃষ্টি করা? ফেলুবাবু আর শঙ্কুর কথা তো অনেক হল, আমার সৃষ্টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একটু ভাবুন না।