উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে শান্তিনিকেতন বেঁচে থাকবে তো!‌

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

গলিতে গলিতে, এ বাড়ির কার্নিশ, ও বাড়ির দেওয়ালে, লাইটপোস্টের মাথায় শুধু বড় বড় হোর্ডিং আর ব্যানার। আর তাতে বড় বড় করে লেখা “……..অনুপ্রেরণায়…………”। রাজপথেও একই ছবি। ফ্লাইওভারের দুই প্রান্তে, মাঝখানে। হাসপাতালে ঢোকার গেটের সামনে। হাসপাতালের দেওয়ালের গায়ে। স্কুল-কলেজের বিল্ডিং এর দেওয়ালে সর্বত্র এক ছবি। শুধু বড় বড় ফ্লেক্স,হোর্ডিং আর ব্যানারে “অনুপ্রেরণা” আর “উন্নয়ন” এই শব্দদুটো লেগেই আছে। সঙ্গে তার মুখশ্রীর ছবি। যেন মুখশ্রীর ছবি না দিলে বাংলার সাধারণ মানুষ এসব বিশ্বাস ই করবে না ! তাই হাস্যময়ী ছবির উপস্থিতি একেবারে বাধ্যতামূলক। জনগণের করের টাকায় দার্জিলিং থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জুড়ে শুধু হোর্ডিং আর হোর্ডিং। সেই প্রচার থেকে দুর্গাপূজা, কার্নিভ্যাল, কালীপুজ়ো, মেলা, উৎসব—- এমনকি বাঙালির ঐতিহ্যের চলচ্চিত্র উৎসব ও বাদ গেল না !

nandan2

এমনিতেই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে নিজের ছায়াকেও তিনি বিশ্বাস যে করেন না, তা সর্বজনবিদিত। তাই এভাবেই আত্মপ্রচার করে তাঁকে বাংলার জনসাধারণকে বিশ্বাস করাতে হয়, যে রাজ্যজুড়ে তার সরকার দারুণ কাজ করছে ! “গলি থেকে রাজপথ” আর কেউ নয়, শুধু একমেবাদ্বিতীয়ম তিনিই থাকবেন। সাতবছর ধরে প্রকাশ্যে বলে বেড়ান তিনি যে বিগত বাম সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা চাপিয়ে চলে গেছে। তাঁর রাজকোষে নাকি “মা ভবানী” অবস্থা ! অথচ জনগণের করের টাকায় এইভাবে আত্মপ্রচার করার সময় মনে হয় কোনও কুবের এসে তাঁকে ধনভাণ্ডারের সন্ধান দিয়ে যান। সারা বছর ধরে আজ ইলিশ উৎসব, কাল মিষ্টি উৎসব, পরশু অমুক উৎসব এসব তো লেগেই আছে—আর এইসব মোচ্ছবের প্রচার হচ্ছে কয়েকশো কোটি টাকার ব্যানার আর ফ্লেক্স ছাপিয়ে। দুর্গাপুজ়োর বিসর্জনের নামে কার্নিভ্যাল হচ্ছে, তার প্রচারে এই বিজ্ঞাপন লাগানো শুরু হয় এক সপ্তাহ আগে থেকে। চলে কার্নিভ্যালের পরে আরও সাত দিন। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর উদ্বোধনের নামে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হয়। তাঁর কোষাগারে নাকি “মা ভবানী” অবস্থা ! অথচ রাজ্যের কয়েক হাজার বেকার যুবক-যুবতীর জন্য তাঁর কোনও দায়িত্ব আছে বলে তো মনে হয় না। সাত বছরে না আছে কোন শিল্প, না কোনও উদ্যোগ। যে হাসপাতালকে তিনি মাল্টিস্পেশালিটি বলে প্রচার করে বেড়ান, তার আভ্যন্তরীণ অবস্থা তা যে কী, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। নীল–‌সাদা রং করে, বড় বড় হোর্ডিং টাঙিয়ে রাখেন যে উড়ালপুল গুলোর গায়ে, তারাই যত্রতত্র ভেঙে পড়ছে মানুষের মাথার ওপর। মুখ্যমন্ত্রীর কোনও চিন্তাই নেই। তিনি হাসিমুখে দায় এড়িয়ে বলে দেন, ‘‌ওগুলো বাম সরকারের “টেন্ডার” রা বানিয়েছিল কিনা। আমাদের দোষ নেই।’‌ আর শিক্ষার অবস্থা ? কলেজে কলেজে তোলাবাজদের আখড়া। কোথাও অনার্সে ভর্তি হতে ২০ হাজার তো কোথাও আবার ৪০ হাজার টাকার প্রণামী । টেট, এস.এস.সি কোনও পরীক্ষাই হয় না এখন আর। শেষ কবে এস এস সি হয়েছিল, জিজ্ঞেস করুন। কেউই হয়ত বলতে পারবে না। অথচ শিক্ষায়তন গুলোর গেটের সামনে বড় বড় হোর্ডিং ঝুলছে—”এগিয়ে বাংলা, শিক্ষায়”।

mamata

সম্প্রতি কোলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব নিয়েও যে ছবি সামনে এসেছে, তা কেবল অপমানজনক ই শুধু নয়, তা রুচিহীনও বটে। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের স্থান “নন্দন” আদপেই বাঙালির সাংস্কৃতিক বিনোদনের পীঠস্থান। তার ঐতিহ্য সেই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই। অথচ সেই “নন্দন” চত্বরে আপনি যান। আপনার যতসময় লাগবে সেখানে সত্যজিৎ রায়কে খুঁজে পেতে, তার ১০ ভাগের একভাগ সময়ে আপনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে খুঁজে পেয়ে যাবেন। “নন্দন”-“রবীন্দ্রসদন” সর্বত্র এক ছবি। যেন সত্যজিৎ রায় নন, মুখ্যমন্ত্রী ই “নন্দন” এর রূপকার। তিনিই একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, তিনিই অভিনেত্রী, তিনিই সব। প্রেক্ষাগৃহের গায়ে, ভেতরে ঢোকার দরকার সামনে, টিকিট কাউন্টারে—সর্বত্র তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি ! বিগত বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিন্দুকেরা “নন্দনপ্রিয়” বলে থাকত। কিন্তু বুদ্ধবাবুর মত সজ্জন, সংস্কৃতি এবং নাট্যপ্রিয় মানুষ তাঁর ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্বে কোনওদিন “নন্দন” চত্বর তো দূর অস্ত, নন্দনের শৌচালয়ের পাশেও পর্যন্ত নিজের নাম খোদাই করে রাখেননি। আর তাঁর উত্তরসূরী? সরকারি টাকায় একের পর এক হোর্ডিং, ব্যানার লাগিয়ে “নন্দন” এর সেই গরিমাময় ঐতিহ্যকেই দিনের পর দিন কালিমালিপ্ত করে চলেছেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে নিজের নামে প্রচার করে বিদেশের চলচ্চিত্রকুশলীদের সামনে বাংলার সংস্কৃতি এবং গৌরবগাথাকে কোথায় নামিয়ে আনছেন !

মাননীয়া, শুধু রবি ঠাকুরের প্রাণকেন্দ্র “শান্তিনিকেতন” টাই এখনও আপনার “অনুপ্রেরণা” থেকে বেঁচে আছে। ভয় হয়, সেটাও কোনওদিন “উন্নয়ন” নামের বিষের ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে না তো ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *