সজল মুখার্জি
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত’ শিক্ষক কথাটা। শুনলেই মনে মনে কেমন একটা শ্রদ্ধার ভাব তৈরি হত। এই শিক্ষক নিশ্চয় আদর্শ শিক্ষক, তাই রাষ্ট্রপতি তাঁকে পুরস্কার দিয়েছেন। আরেকটু বড় হওয়ার পর জানলাম, প্রতি বছর শিক্ষক দিবসের দিন রাষ্ট্রপতি এই পুরস্কার তুলে দেন। সব রাজ্যের সেরা কয়েকজন শিক্ষক এই পুরস্কার পেয়ে থাকেন।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তারপরেই এমন কয়েকজনকে এই পুরস্কার পেতে দেখলাম, শিক্ষক হিসেবে যাঁরা মোটেই তেমন শ্রদ্ধেয় নন। নিজের স্কুলের ছাত্রদের কাছেও তিনি ততটা প্রিয় নন। এলাকাতেও তেমন সুনাম নেই। তাহলে, কীভাবে পেলেন এই পুরস্কার? কারাই বা দিলেন? কী দেখেই বা দেওয়া হল?
তখনই প্রথম জানলাম, এই পুরস্কার কেউ নিজে থেকে পান না। আবেদন করতে হয়। নানা লোকের কাছ থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হয়। উপযুক্ত জায়গায় দরবার করতে হয়। ঠিকঠাক লোক ধরতে হয়। রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে হয়। ছোটবেলা থেকে লালন করে আসা ধারনাটা কেমন যেন বদলে গেল। আস্তে আস্তে কানে আসতে লাগল, কোন স্কুলের কোন কোন শিক্ষক এই পুরস্কারের জন্য ছোটাছুটি করছেন। এর–তার কাছে তদ্বির করছেন। প্রভাবশালীদের কাছে সার্টিফিকেট জোগাড় করে চলেছেন।
তারপর থেকেই এই পুরস্কার নিয়ে ধারনাটা কেমন যেন বদলে গেল। যাঁরাই এই পুরস্কার পান, তাঁর ক্ষেত্রেই মনে হয়, এই ভদ্রলোককে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেক লোকের কাছে যেতে হয়েছে। নিজের হয়ে বিস্তর ওকালতি করতে হয়েছে। ঠিকঠাক ‘লোক’ খুঁজতে হয়েছে। অর্থাৎ, পুরস্কার পাওয়ার জন্য এমন অনেক কিছুই করতে হয়েছে, যা একজন শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশিত নয়। সেই ট্রাডিশন আজও চলেছে।
আজও কেউ জাতীয় শিক্ষক শুনলে শ্রদ্ধার চেয়ে বেশি অন্য ছবিটাই ভেসে ওঠে। দিনের পর দিন এই সিস্টেম কীভাবে চলে আসছে? যেটা আমার মতো সাধারণ মানুষের মাথায় ঢোকে, সেটা এত বড় বড় শিক্ষাবিদের মাথায় ঢোকে না? একজন শিক্ষক কেন নিজের হয়ে ওকালতি করবেন? কেন নিজের হয়ে নিজেকেই ঢাক পেটাতে হবে? কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকের পক্ষে কি এভাবে ‘লবি’ করা সম্ভব? এভাবে হন্যে হয়ে নিজের জন্য প্রশস্তিমূলক সার্টিফিকেট জোগাড় করা সম্ভব? আবার উল্টোটাও সত্যি। যিনি এই পুরস্কারের জন্য এভাবে মানসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে ‘লবি’ করে গেলেন, তিনি কি সত্যিই জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য?
আমার মনে হয়, এবার এই সিস্টেমে বদল আনা দরকার। যোগ্য শিক্ষকদের সরকার পুরস্কৃত করতেই পারে। কিন্তু তার জন্য যেন শিক্ষককে নিজের হয়ে তদ্বির করতে না হয়। যোগ্য শিক্ষক কীভাবে খোঁজা হবে, সেটা শিক্ষাবিদরা ভাবুন। জেলাশাসকের রিপোর্ট নেওয়া হতে পারে। শিক্ষাকর্তারা খোঁজ খবর রাখুন। জেলা শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা খোঁজ রাখুন। দরকার হলে জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মতামত নেওয়া হোক। এইভাবে খুঁজে নেওয়া হোক জাতীয় শিক্ষককে। যদি না পারেন, পুরস্কার দেওয়ার এই প্রথা বন্ধ করা হোক। নিজের জন্য লবি করা লোকেদের আর যাই হোক, জাতীয় শিক্ষক হিসেবে মানায় না।