অভিরূপ অধিকারী
জীবনে কত সন্ধ্যা আসে। হারিয়েও যায়। কিন্তু কিছু সন্ধ্যা চিরন্তন হয়ে থেকে যায়। আমার জীবনে তেমনই এক সন্ধ্যে এসেছিল বছর সাতেক আগে। সেই প্রথম চোখের সামনে দেখেছিলাম লতা মঙ্গেশকারকে। শুধু কি লতা ? আরেক কিংবদন্তি আশা ভোঁশলে। ছিলেন দুই বোন ঊষা ও মীণা। আর ছিলেন ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকার। একমঞ্চে পুরো মঙ্গেশকার পরিবার ? যেন স্বপ্নের মতো।
অনেক বড় বড় শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখেছি। বেশ কয়েকবার আশা ভোঁশলের গানও শুনেছি। তিনি তো আগেও বেশ কয়েকবার কলকাতা এসেছেন। কিন্তু লতা! তিনি তো তার আগের পঁচিশ বছরে এই রাজ্যে পাও রাখেননি। আর তাই দেখার সুযোগও হয়নি। সেবার কয়েকদিন আগে থেকেই হাওয়ায় ভাসছিল খবরটা- ২৪ ঘণ্টার অনন্য সম্মান অনুষ্ঠানে নাকি লতা মঙ্গেশকার আসতে পারেন। ব্যাস, সেদিনই ঠিক করে ফেললাম, যেভাবেই হোক, এই অনুষ্ঠানে থাকতেই হবে। কিন্তু কী করে যাব ? আমার কাছে তো কার্ড নেই। আবার টাকা দিয়ে টিকিট কাটব, সেই রাস্তাও খোলা নেই। অগত্যা, পাকড়াও করলাম এক পরিচিত দাদাকে। যেভাবেই হোক, টিকিট জোগাড় করে দিতেই হবে। একেবারে জোঁকের মতো লেগে ছিলাম। শেষদিন পর্যন্ত উৎকণ্ঠা। অবশেষে টিকিটটা হাতে পেলাম অনুষ্ঠানের দিন সকালে। ছুটলাম সায়েন্স সিটিতে। কী জানি, এমন সুযোগ হয়ত আর পাব না।
এসেই মন খারাপ হয়ে গেল। লোকজন বলাবলি করতে লাগল, লতাজির শরীর খারাপ। নাও আসতে পারেন। একে-তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। একেকজনের কাছ থেকে একেক রকম উত্তর পাওয়া গেল। পরে একজন আশ্বস্ত করলেন, উনি আসছেন। আবার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। এমনিতে এখন ইটারনেট আর ইউটিউবের দৌলতে অনেক অনুষ্ঠান দেখা যায়। কিন্তু সামনাসামনি দেখার রোমাঞ্চই আলাদা। লতাজি এলেন। এলেন মঙ্গেশকার পরিবারের বাকি ভাই-বোনরাও। ঠিক দেখছি তো ? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
সেদিন ঠিক কী বলেছিলেন লতাজি ? আজও পরিষ্কার মনে আছে। মোবাইলে রেকর্ডও করা ছিল। আরও একবার চালিয়ে শুনে নিলাম। লতাজি যা বলেছিলেন, তার কিছু অংশ তাঁর মুখেই শোনা যাক – গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০ জন্মদিবস। তাঁর পবিত্র আত্মা ও স্মৃতিকে প্রণাম করি। অনেকদিন পর কলকাতায় এলাম। গতকালই আসার কথা। কিন্তু শরীরটা হঠাৎ কারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার বলল, ভাইরাল জ্বর। কিন্তু এখানে আমার আসাটা খুব জরুরি ছিল। হ্যাঁ, আজ আমি আপনাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
কলকাতা আমাকে কতখানি ভালবাসে, তা আমি জানি। সেই সম্পর্ক অনেকদিনের। ছোটবড় সবাই আমাকে আশীর্বাদ করুন, যেন আরও গাইতে পারি। আমার গান আপনাদের ভাল লাগলে, তা আমারও ভাল লাগবে।
সলিলদা, হেমন্দদা, হৃদয়নাথের সুরে কত বাংলা গান গেয়েছি। কিন্তু এখন ভাল বাংলা বলতে পারি না। আপনাদের হয়ত শুনে হাসি পাবে। আমার প্রথম বাংলা গান সলিলদার সুরে। গান দুটো ছিল- ‘না যেও না’ ও ‘সাতভাই চম্পা’। সলিলদা বলতেন, বাংলা বলো, হিন্দি বোলো না। হেমন্তদা তো আমার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন। ঋষিকেষ মুখার্জিও বলতেন বাংলায় কথা বলতে। ওঁরা যতদিন ছিলেন, আমিও বাংলাতেই কথা বলতাম। এখন ওঁরাও নেই। বাংলায় কথা বলার লোকও নেই। তাই বাংলা চর্চাটাও নেই। আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অথচ, হিন্দির পর সবথেকে বেশি গান তো এই বাংলাতেই গেয়েছি। বাংলা ভাষা খুব ভাল, খুব মিষ্টি। যেমন মিষ্টি এখানকার ভাষা, এখানকার মানুষও ততটাই মিষ্টি। সবাইকে আমার প্রণাম।
গোটা সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ল হাততালিতে। আমিও তখন মন্ত্রমুগ্ধ। আরও বিস্ময় তখনও বাকি ছিল। এবার বোন আশা। তিনি অবশ্য শুরু করলেন বাংলাতেই। বললেন, আমি সব বুঝতে পারি, তবে এখন আগের মতো বলতে পারি না। পঞ্চমের সঙ্গে খুব বাংলায় ঝগড়া করতাম। ও মাঝে মাঝেই আমার উপর রেগে যেত। বাংলায় চিৎকার করত। আমিও করতাম। ও কলকাতার অনেককিছুই ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এমনকি সেই স্কুল, যেখানে ও ফেল করেছিল।
আমরা পাঁচ ভাই বোন এসে হাজির। আমরা একসঙ্গে কলকাতা ছাড়া আর কোথাও যাইনি। মুম্বইয়ের দু-একটা অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে। কিন্তু তার বাইরে এই প্রথম। ১২ খানা রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করেছিলাম। আমি জানি, আপনারা সেগুলো আজও শোনেন। ৬৫ বছর ধরে আপনারা আমাদের গান শুনে আসছেন। আরও রেকর্ড করতে চাই, আপনারা শুনে যান।
এত অতিথির সমাগম। যেন চাঁদের হাট। কে নেই সেখানে ! খেলা থেকে গান, সিনেমা থেকে সাহিত্য, সব জগতের দিকপালরাই হাজির। কাকে ছেড়ে কার দিকে তাকাব ? কার দিকে আবার ! অনেক তারার মাঝে ধ্রুব তারা তো একজনই।