সব্যসাচী কুণ্ডু
টিভির প্যাকিং কেসটা খুলতে খুলতে অঙ্কুর মনে মনে প্রার্থনা করছিল, এবার টিভিটা যেন অক্ষত থাকে। গতবার উত্তরপ্রদেশ থেকে পাঞ্জাবে বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় টিভিটা ভেঙে গিয়েছিল। এত টাকা দিয়ে প্যাকারস-মুভারস বুক করেও সেবার টিভিটা বাঁচাতে পারেনি। তবে এবার ঠিক আছে।
একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অঙ্কুর চাকরি করে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তাকে কাজের খাতিরে থাকতে হয়। কিন্তু দু তিন বছরের বেশি না! গত পনের বছরের চাকরি জীবনে তাকে অনেক জায়গা ঘুরতে হয়েছে। এবার ট্রান্সফার হল বিশাখাপত্তনমে। প্যকারস-মুভারস কোম্পানি তার জিনিস পত্র নতুন ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এসি, ফ্যান, জলের ফিল্টার সব লাগানো হয়ে গেছে। শুধু ডিশ টিভির লোক এলেই টিভিটা ফিটিং হয়ে যাবে।এবার অনেক খুঁজে খুঁজে ছেলের স্কুলের ঠিক কাছেই একটা ফ্ল্যাট পেয়ে গেছে। তবে তার জন্য পরিশ্রম নেহাত কম হয়নি! একে তো অজানা জায়গা, তার ওপর তেলেগু ভাষা। প্রচুর ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে এবার। একটা মাঝারি সাইজের অ্যাপার্টমেন্ট, তাতে গোটা আটেক ফ্ল্যাট। অঙ্কুর সেকেন্ড ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। জায়গাটা বেশ ছিমছাম, শান্ত। আর প্রচুর গাছপালা। বাড়ির কাছাকাছি দু চারটে দোকানও চোখে পড়েছে। একটা সেলুন আর একটা খাবারের দোকানও আছে। ছেলের স্কুল খুলতে খুলতে সেই জুলাইয়ের মাঝামাঝি হবে। তাই ও ছেলে আর বউকে কলকাতায় রেখে এসেছে। স্কুল খোলার আগে ওদের নিয়ে চলে আসবে, তার আগে ফ্ল্যাটটা একটু গোছগাছ করে নিতে হবে। এখানে আসার পর অঙ্কুর পাঞ্জাবের আবহাওয়া আর এখানের আবহাওয়ার অমিলটা বেশ ভাল রকম অনুভব করেছে। এখানের প্রজেক্টে জয়েন করার পর সে কিছুদিন কোম্পানির গেস্ট হাউসে ছিল। থাকা খাওয়ার কোনও অসুবিধা ছিল না। আজ সকালেই সে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছে। এক দুদিন খাওয়া দাওয়ার একটু সমস্যা হবে, তবে গ্যাস সিলিন্ডার পেয়ে গেলে নিজেই রান্না করে খাবে। এখানকার হোটেলের খাবার যে তার পেটে সইবে না, সেটা সে এক দুবার খেয়েই ভালভাবে বুঝে গেছে।
সকাল থেকে পরিশ্রমটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তাই হোটেল থেকে আনা রাতের খাবার খেয়ে আজ একটু তাড়াতড়িই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। মোবাইলে দেখল, রাত দশটা পনেরো। কাল সকাল থেকে কী কী করবে, কোন কাজটা আগে করবে, এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা মতন এসে গেল। কিন্তু খুঁট খাট খস খস আওয়াজে ঘুমটা কেটে গেল। পাসের রুম থেকেই হচ্ছে মনে হল! একবার ভাবল উঠে দেখবে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই সে চিন্তা ত্যাগ করে বিছানাতেই শুয়ে রইল। কিন্তু আওয়াজটা থামল না। বেড়েই চলেছে। এবার বেশ অনুভব করল, যে এই ফ্ল্যাটে সে একা নয়। আর একজনের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। অঙ্কুর যেখানে শুয়ে আছে, তার চোখের সোজাসুজি দরজাটা। এসি চলছে বলে দরজা জানালা সব বন্ধ। কিন্তু চোখে সয়ে আসা পাতলা অন্ধকারে বেশ বোঝা যাচ্ছে এই রুমেই সে আছে, একটা লোমশ চতুষ্পদ প্রাণী তার আগুনে চোখ দিয়ে অঙ্কুরের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর খুঁট খাট খস খস আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে। ভয়ে বিস্ময়ে অঙ্কুরের সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। চব্বিশে এসি চলছে তবুও ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। হাত পা গুলো কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর অঙ্কুরের মনে হোল যে , সকালে মালপত্র ওঠানোর সময় কুকুর টুকুর কিছু ঢুকে যায়নি তো? হয়তো কোথাও একটা ঘাপটি মেরে ছিল। এখন নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে । এই ভেবে সে মনে খানিকটা জোর এনে সুইচ বোর্ডের দিকে হাত বাড়াল। ঘরের আলো জ্বলতেই সে দেখল, দরজার কাছে তো কিছু নেই। বিছানার তলাটা, আলমারির পেছনটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। তাহলে সে কি ভুল দেখেছে? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিল ? এর আগেও তো কত জায়গায় সে দিনের পর দিন একা থেকেছে। কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা তো আগে কখনও হয়নি! এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অঙ্কুর আবার শুয়ে পড়ল। লাইটটা জ্বালানোই রইল।
মোবাইলের অ্যালার্মে অঙ্কুরের ঘুমটা ভেঙে গেল। ছটা বেজে গেছে। রাতে আর তেমন কিছু ঘটেনি। তবে একটা কুকুরের কান্নার আওয়াজ যে মাঝে মাঝে শুনেছে এটা বেশ মনে আছে । বাইরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই একটা স্নিগ্ধ ভোরের হাওয়া মুখে এসে লাগতেই সব গ্লানি দুশ্চিন্তা এক পলকে দূর হয়ে গেল। ব্যালকনিতে দাড়িয়ে সে ভোরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগল। রাতের ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলতে চাইল। বাড়ির কাজ শুরু করার আগে পুরো ঘরটা ভাল করে দেখে নিলো অঙ্কুর। না, তেমন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। বাড়িটা একটু ঠিক ঠাক গোছানোর জন্য সে অফিস থেকে দুদিন ছুটি নিয়েছিল। আর একটা দিন হাতে আছে, তাই যতটা পারা যায়, কাজ গুছিয়ে ফেলতে হবে। তাই সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। কিন্তু রাতে আবার একই ঘটনা ঘটল ।
সব ভয় দুশ্চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতে চাইলেও আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে অঙ্কুর কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু এভাবে তো থাকা যায় না। সারাদিন খাটা খাটনির পর যদি রাত্রে ঘুম না হয়, তাহলে তো মুশকিল। সারারাত লোমশ চতুষ্পদটার ঘোরা ফেরা আর কান্নার আওয়াজ শুনে শুনে অঙ্কুর বিরক্ত। ঠিক করল, এর শেষ দেখে ছাড়বে। কিন্তু এই ঘটনাটা কার সঙ্গেই বা আলোচনা করবে? বিশ্বাস করবেই বা কজন? আর আশেপাশের কাউকে তো ও চেনেও না! অফিসের কলিগদের বললে হয়তো তাকে পাগল ভেবে বসবে। কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হবে। আগে ঘটনাটা কেন ঘটছে, তার একটা কারণ খুঁজতে হবে। তার আগে এই ফ্ল্যাটটার ইতিহাস জানাটা খুব দরকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষে ম্যাজিক ব্রিকস ডট কম থেকে বিজ্ঞাপন দেখে সে ফ্ল্যাটটা বুক করেছিল। ফ্ল্যাটের মালিক সপরিবারে হায়দ্রাবাদে থাকেন। তাঁর এক ভাই অবশ্য কাছে পিঠেই থাকেন। তাঁর কাছে একবার গেলে হয় না ? এই সব ভাবতে ভাবতে অঙ্কুরের মনে হোল, আগে বাড়ির দারোয়ানকে একবার জিজ্ঞাসা করা যাক। যদি উনি কিছু আলোকপাত করতে পারেন। নিচে গিয়ে দারোয়ানকে পাওয়া গেল। তবে সে এই অ্যাপার্টমেন্ট সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। কারণ এখানে সে নতুন জয়েন করেছে। আগের দারোয়ান অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়াতে সে কাজটা পেয়েছে। তবে এর কাছে আগের দারোয়ানের বাড়ির ঠিকানাটা পাওয়া গেল। ঠিকানায় পৌঁছে আগের দারোয়ানের দেখা পাওয়া গেল। নাম কৃষ্ণমূর্তি, বয়েস আন্দাজ পঞ্চান্ন, কিন্তু অসুস্থতার কারণে আরও বয়ষ্ক লাগছে। শীর্ণ একহারা চেহারা, চোয়াল বসে গেছে। মাথার চুল ধবধবে সাদা। খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন। হিন্দিটা একটু আধটু বোঝেন, আর বলতেও পারেন। অঙ্কুর কোনো ভণিতা না করে তাঁকে সমস্ত কিছু খুলে বলল। উনি সব মন দিয়ে শুনলেন এবং বিশ্বাস করলেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর উনি বললেন, এই অ্যাপার্টমেন্টটা আজ থেকে চার বছর আগে তৈরি হয়েছে, প্রথম থেকেই আমি ওখানে কাজ করছি। তুমি যে ফ্ল্যাট টা ভাড়া নিয়েছ, ওখানে আগে ভিক্টর প্রেমাসাগর বলে একজন খ্রিষ্টান ভদ্রলোক থাকতেন। বয়েস ছিল ওই পঞ্চাশের কোঠায়। ওনার স্ত্রী অনেকদিন আগেই গত হয়েছিলেন । একমাত্র ছেলে কর্মসূত্রে আমেরিকায় থাকে আর মেয়ে থাকে কেরালাতে। ভদ্রলোক খুব মিশুকে আর অমায়িক ছিলেন। প্রায়ই আমাকে বকশিশ দিতেন। তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল তাঁর কুকুর, হোজো! সকাল বিকেল বেড়াতে যেতেন। কুকুরটাও সঙ্গে থাকতো। একদিন রাতে বুকে অসম্ভব ব্যথা নিয়ে হাসপাতলে ভর্তি হলেন । তিন দিন পর তিনি গত হলেন । সেইদিনটা আমি কিছুতেই ভুলব না! ভিক্টর সাহেব হাসপাতলে ভর্তি হওয়ার পর হোজোর দেখাশোনা আমিই করতাম। সেদিন শত চেষ্টা করেও হোজোকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। কী জানি ও কী করে বুঝতে পারল! সারাদিন শুধু কেঁদেছে। আর চেনটা দাঁত দিয়ে চিবিয়েছে।কিছুক্ষণের জন্য আমি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ওকে নজর দিতে পারিনি। ফিরে এসে আর ওকে দেখতে পাইনি। চেন ছিঁড়ে পালিয়ে গেছে। ঘন্টা খানেক পর খবর পেলাম মেন রোডে একটা কুকুর চাপা পড়েছে। দৌড়ে গেলাম, কিন্তু পৌঁছে দেখলাম সব শেষ! হোজো আর নেই। পুরসভার লোক এসে বডিটা নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে আমি ওর গলা থেকে বেল্টটা খুলে নিয়েছিলাম। আমাকেও কয়েকবার ও দেখা দিয়েছে। হয়তো ওর মনিবের খোঁজ নিতে আসতো। খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল হোজোর উপর। তারপর অঙ্কুরের হাতে একটা লাল রঙের চামড়ার বেল্ট দিয়ে বললেন, এটা নিয়ে যাও, তোমার কাজে লাগবে।
ওঁর বাড়ি থেকে অঙ্কুর সোজা কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ঠিকানাটা আগেই জেনে নিয়েছিল।কবরস্থানে পৌঁছে সেখানকার কেয়ার টেকারকে জিজ্ঞাসা করতেই উনি ভিক্টর সাহেবের সমাধিটা দেখিয়ে দিলেন। ভিক্টর সাহেবের সমাধির পাশে একটা গর্ত খুঁড়ল অঙ্কুর। সেখানে বেল্টটা সমাধিস্থ করে সমাধির ওপরে একটা ফুলের তোড়া রেখে দিল আর কতোগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। এখানে আসার সময় আর একটা জিনিস অঙ্কুর কিনে এনেছিল, একটা পাথরের ফলক। ওটা হোজোর সমাধিতেও লাগিয়ে দিল। ওতে লেখা আছে, হোজো রেস্ট ইন পিস।
1 comment
Khub sundor hayeche kundu da. Great. Agiye jan