স্বরূপ গোস্বামী
অন্যের সমালোচনা করা খুব সহজ। লোককে জ্ঞান দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু মাঠে নেমে দায়িত্ব পালন করা বেশ কঠিন।
এই সহজ সত্যিটা মাথায় রেখেই এই লেখাটা লিখছি। জানি, অনেক বামপন্থী বন্ধুর ভাল লাগবে না। হয়ত অনেকে পাল্টা জ্ঞান বিতরণ করবেন। পুরো লেখাটা না পড়েই ‘তৃণমূলের দালাল’ তকমা এঁটে দেবেন। তবু লিখছি। কারণ, এই কঠিন সময়ে অল্পবিস্তর আত্মসমালোচনাও জরুরি।
বেশি বড় ভূমিকা না করাই ভাল। শুরুতেই বলে নেওয়া যাক, বামেদের সেই অর্থবল নেই। সেই প্রভাব নেই। সেই প্রচার নেই। কোথাও কোথাও যেটুকু কাজ হচ্ছে, আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। মূলস্রোত মিডিয়ায় আসছে না। অনেকেই নিজের নিজের এলাকায় দুঃস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। মূলস্রোত মিডিয়ায় না এলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেসব ছবি আসছে।
এই লেখার বিষয় একেবারেই অন্য। মূলত পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে। কোনও সন্দেহ নেই, এত দিন পরেও সরকার এখনও তালিকা তৈরি করতেই পারল না। কোন জেলা থেকে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্যে আটকে আছেন, এই সংক্রান্ত কোনও তথ্যই সরকারের কাছে নেই।
কিন্তু বামেরা তো এই কাজটা সহজেই করতে পারতেন। খুব কি কঠিন কাজ ছিল? অন্তত এই বার্তাটুকু তো দেওয়া যেত, সরকারি মেশিনারি এক মাসেও যা করতে পারে না, বামেরা দুদিনে সেই তালিকা তৈরি করতে পারেন।
কীভাবে? একেবারে পঞ্চায়েত স্তর থেকে। পঞ্চায়েতে প্রার্থী দেওয়া যায়নি ঠিকই, কিন্তু বুথ পিছু পাঁচজন সক্রিয় কর্মী নেই, এটা বিশ্বাস হয় না। সবাই নিজের নিজের এলাকার তালিকা করে অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকে দিতে পারতেন। অঞ্চল থেকে আসত এরিয়া কমিটিতে। সেখান থেকে জেলায়। আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ মারফত পাঠালে তো আরও তাড়াতাড়ি হতে পারত। তার বদলে অনেকে শর্ট কার্ট রাস্তাটাই বেছে নিলেন। পরিযায়ীদের ফিরিয়ে আনতে হবে— এরকম একটা দাবি হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। কেন, এই তালিকা তৈরি করে বিডিও–কে দেওয়া যেত না! কে এত পরিশ্রম করে?
মালদা, মুর্শিদাবাদ বা উত্তর দিনাজপুরে সংখ্যাটা একটু বেশি। অন্যান্য জেলাগুলোয় বুথ পিছু গড়পড়তা ১০–১২ জন শ্রমিক বাইরে আছেন। সেই শ্রমিকদের নাম, কোথায় আছেন, ফোন নম্বর, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট— এগুলো জোগাড় করা কি খুব কঠিন ছিল? ধরা যাক, দশ জন বাইরে আটকে আছেন। গ্রামে সমমনষ্ক কিছু মানুষের কাছে কালেকশন করে কি দশ হাজার টাকা উঠত না? তাহলেও তো একেকজনের অ্যাকাউন্টে এক হাজার টাকা করে পাঠানো যেত। পাঁচ হাজার উঠলে না হয় পাঁচশো করে পাঠানো যেত।
মানছি, এক হাজার বা পাঁচশো কিছুই নয়। তাতে কদিনই বা চলবে! হয়ত সাতদিন চলত। সাতদিন পর আবার না হয় চেষ্টা করা যেত। তবু অন্তত বার্তাটা দেওয়া যেত, সরকার পৌঁছনোর আগে, আমরা পৌঁছতে পেরেছি। বামেরা এক হাজার পাঠানোর পর স্থানীয় তৃণমূল নেতা হয়ত দু হাজার পাঠাতেন। বা আরও বেশি। কিন্তু প্রথম কারা পাশে দাঁড়িয়েছে, শ্রমিকরা ও গ্রামের মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতেন।
মানছি, চাঁদা দেওয়ার লোক কমে গেছে। গ্রামে গ্রামে সেই নিবিড় সংগঠনটাও নেই। অনেক ফাঁক থেকে যেত। কিন্তু চেষ্টাটা তো করা যেত। একেকটা ব্লকে প্রায় দুশো গ্রাম। সব গ্রামে হয়ত এমনটা সম্ভব হত না। কুড়িটা গ্রামেও তো করা যেত। এখনও অনেক শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী আছেন যাঁরা বাম মনষ্ক। তাঁরা পাঁচশো বা হাজার টাকা অনায়াসে দিতে পারতেন। অনেকেই দিতে চান। সেই সদিচ্ছাও আছে। কিন্তু চাওয়ার লোকের বড্ড অভাব। চাইলেও, সেই মুখ কতখানি বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়েও প্রশ্ন।
সরকারের সমালোচনা করা খুব সহজ। ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীকে বা প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করাও সহজ। কিন্তু কঠিন সময়ে সীমিত শক্তি, সীমিত সামর্থ্য নিয়েও কিছু ইতিবাচক ছাপ রাখা যেত। তার কতটুকু করা গেল? রাষ্ট্র পারল না, রাজ্য সরকার পারল না। শূন্য আসন পাওয়া একটা দল পরিযায়ীদের তালিকা তৈরি করতে পারল। তাঁদের কাছে সীমিত সামর্থ্য নিয়ে পৌঁছতে পারল। এই কঠিন সময়ে এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়া খুব জরুরি ছিল। কিন্তু বাম নেতৃত্ব আবার পিছিয়ে গেলেন।
শুধু অন্যকে গালমন্দ করলে জনভিত্তি ফিরে আসে না। হারানো বিশ্বাস ফিরে আসে না। একটু একটু করেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হয়। আবার সেই সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল। নিশ্চিত থাকতে পারেন, এরপরেও আত্মসমীক্ষার দরজা–জানালা বন্ধই থাকবে।