সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
গতকাল টিভি চ্যানেলে দেখলাম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী উম্ফুন ঝড়ের পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। যা যা তিনি বলেছেন তার সারমর্ম, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বাংলায় তাঁর পরিচালিত সরকার এবং প্রশাসন সীমাহীন তৎপরতার সঙ্গে কাজ করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য দায়ী পূর্বতন বাম সরকার। কারণ C.E.S.C. তাদের শাসনেই বেসরকারিকরণ হয়েছিল। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা কোনও রাজনৈতিক দলের অঙ্গুলিহেলনে রাস্তায় নেমে অবরোধ করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং তিনি এই দুর্দিনে সকল বঙ্গবাসীকে “ক্ষুদ্র রাজনীতি” না করার নিদান ও দিয়েছেন।
আসলে বাংলা তথা দেষের মানুষের রাজনৈতিক বোধের অসাড়তার কারণেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা দিনের পর দিন এইরকম নিলর্জ্জভাবে নির্ভেজাল মিথ্যে কথা বলার সাহস পান। ২০১১ সালে বাংলায় ক্ষমতা দখলের পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়েই তিনি সরকারি হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় বিগত বাম সরকারকে দায়ী করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর যুক্তি ছিল সেই প্রসূতি মহিলারা গর্ভবতী হয়েছিলেন বাম সরকারের শাসনে, তাই তাঁদের সদ্যোজাতের মৃত্যুর দায় তাঁর সরকারের নয়। তার পর দক্ষিণ কলকাতার আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরেও তিনি অভিযোগ করেছিলেন বাম সরকারের অগ্নি নির্বাপক এবং নিরোধক ব্যবস্থা উন্নতমানের নয়। সেই একই অভিযোগের ধারা দেখা গিয়েছিল উত্তর কলকাতার পোস্তায় উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পরে। নির্বাচনের আগে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি সেই নির্মীয়মান উড়ালপুলের উদ্বোধন করিয়েছিলেন। আর ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেঈ সেই দায় চাপিয়েছিলেন বাম সরকারের শাসনে নিযুক্ত টেন্ডার এর ওপর! মাঝেরহাট উড়ালপুল ভাঙার পরেও সেই অভি্যোগের কোনও ব্যতিক্রম হয়নি।
আজকে কোলকাতা ও শহরতলীর বুকে এক বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনায় অভিযোগের তীর সেই পূর্বতন সরকারের দিকে। বাম সরকার নাকি C.E.S.C কে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছিল ! আচ্ছা, ১৯৯১ সালে ‘বিদ্যুৎ আইন’ তৈরীর সময় আজকের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কোন দলের মন্ত্রী ছিলেন? ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারের শাসনাধীনে ‘বিলগ্নিকরণ দপ্তর’ এর শরিক কে ছিলেন? ২০০৩ সালে দেশে যখন ‘Electricity Act’ প্রণয়ন হয়েছিল, তখন NDA সরকারের মন্ত্রী কে ছিলেন? টিটাগড়ের বিদ্যুৎ কেন্দ্র কে বন্ধ করে সেখানে Real Estate এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন? সঞ্জীব গোয়েঙ্কা কার বিদেশ যাত্রার সফরসঙ্গী হন? সবকটা প্রশ্নের একটাই উত্তর। আজকের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।
আর আজকে তিনি C.E.S.C এর বেসরকারিকরণের দায় আরোপ করছেন বিগত বামসরকারের ওপর? তার সরকার নাকি উন্নয়নের ধারা ছড়িয়ে দিয়েছে দিক-দিগন্তে, দূর-দূরান্তে। ‘এগিয়ে বাংলা’, ‘বিশ্ব বাংলা’ নাকি সারা ভারতবর্ষে সমাদৃত? অথচ আজও তিনি বিগত সরকারের ভূত দেখে বেড়ান!
মুখ্যমন্ত্রী, এই দুর্দিনে কে রাজনীতি করছে বলুন তো ? আমরা ভুলিনি, ২০০৯ সালে দক্ষিণবঙ্গে বিধ্বংসী আয়লার পরে কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কেন্দ্রকে বারণ করেছিল পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারকে ত্রাণ পাঠাতে বা আর্থিক সাহাযা করতে? আয়লা কে “Man-Made” আখ্যা দিয়েছিল কে, সেটাও স্মৃতিতে অমলিন। খবর নিয়ে দেখুন, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সুন্দরবনে এক সত্তরোর্ধ সাদা চুলের প্রবীণ কান্তি গাঙ্গুলি ওই বাম কর্মীদের নিয়েই অসহায় মানুষের পাশে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন, তাঁদের আশ্রয় দিচ্ছেন একটি বেসরকারি স্কুলে, সীমিত ক্ষমতা দিয়েই ত্রাণ সাহায্য করছেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বাম কর্মী, সমর্থকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে উদ্ধারকার্যে। আর আপনি এই ঘোর সঙ্কটের দিনেও বিগত বামফ্রণ্ট সরকারের ভুল খুঁজ়ে বেড়াচ্ছেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের দায় পূর্বতন সরকারের কাঁধে চাপিয়ে নিজের সরকারকে ত্রুটিমুক্ত দেখানোর হাস্যকর খেলা খেলছেন। আর টিভি চ্যানেলে এসে বলছেন, ‘কেউ রাজনীতি করবেন না’? পুরনো একটা প্রবাদ মনে পড়ে গেল, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।