কুণাল দাশগুপ্ত
সেটাও ছিল এক অর্থে ‘শিল্প বিপ্লব’। ব্রিটিশ ভূখণ্ড নয়, শিল্পের এই প্রবল ঝাঁকুনির কেন্দ্রস্থল কলকাতা।
সময়টা ছয়ের দশকের মাঝামাঝি। ১৯৬৪ সাল। রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়কে সেলুলয়েডে বন্দি করলেন সত্যজিৎ রায়। নাম দেওয়া হল চারুলতা। ছবিতে রবি ঠাকুরের আমি চিনি গো চিনি তোমারে গানটিকে ব্যবহার করবেন বলে মনস্থির করলেন রায় সাহেব। গানটি হবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে। কিন্তু গাইবেন কে?
সেই সময়টাতে রবি ঠাকুরের সৃষ্টির ওপর একচ্ছত্র অধিকার ছিল বিশ্বভারতীর। পান থেকে সংস্কারের চুন খসাবে, এমন সাধ্যি কার! বিশ্বভারতীর এই লাগাতার দখলদারির হাত থেকে রেহাই পাননি দেবব্রত বিশ্বাসও। শান্তিনিকেতন মধ্যযুগের ক্যাথলিক চার্চের মতোই আচরণ করত। পৃথিবী স্থির, সূর্য প্রদক্ষিণ করে তাকে, এই মত যেমন অবিনশ্বর, রবি ঠাকুরের গানে কী কী করতে হবে বা হবে না, এক শান্তিনিকেতনী ফতোয়াও অলঙ্ঘনীয় ছিল সে যুগে। অনুশাসনের বাড়াবাড়ি দেখে কার্ল মার্কস একবার বলে বসেছিলেন, থ্যাঙ্ক গড, আই অ্যাম নট দ্য মার্কসিস্ট। স্বাধীনোত্তর সময়ে বিশ্বভারতীর ছুঁৎমার্গ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল, স্বয়ং রবি ঠাকুরের গায়েও তকমা পড়ে যেত, ইনি ঠিক রাবীন্দ্রিক নন।
সত্যজিৎ রায় বিদ্রোহ করে ফেলেছিলেন। তিনি চাইছিলেন একটা নতুন গলা। এমন এক স্বর যা কিনা বোলপুরের বোলচাল থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। শান্তিনিকেতনী শাসন থেকে বহু বহু দূরে অবস্থিত। ডাক পড়ল কিশোর কুমারের। কিন্তু কেন কিশোর কুমার? রুমা গুহঠাকুরতার সূত্রে শুধু নয়, কিশোর কণ্ঠকে এমনিতেই পছন্দ করতেন সত্যজিৎ। ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত মধুর। তিনি চেয়েছিলেন তরুণ সৌমিত্রর ঠোঁটে ঝকঝকে কিশোরের আওয়াজকে বসিয়ে দিতে। সেক্ষেত্রে তিনি একশো শতাংশ সফল। কিশোর কুমার সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করেন গানের রেকর্ডিংটা বম্বেতে করতে। রাজি হয়ে যান তিনি। কিশোর কুমারের রেকর্ড করা গানের ওপর পিয়ানোর আস্তরণ বসিয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। আর কিশোর কুমার কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই করেছিলেন ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে।’ ওই গানটাই যেন ছবিটার ট্রেড মার্ক হয়ে উঠেছে।
সত্যজিৎ আর কিশোর কুমারের মধ্যেকার সম্পর্কের রসায়নটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। শোনা যায়, পথের পাঁচালী ছবির জন্য কিশোর কুমার নাকি আর্থিক সাহায্য করেছিলেন তাঁর মানিকমামাকে। সত্যজিৎ রায় কিশোরের হিন্দি গানের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। তাঁর পছন্দের কিশোর কুমারের গাওয়া বেশ কিছু গানের উল্লেখ তিনি করেছেন বিভিন্ন আলাপ আলোচনায়। কিশোর কুমারের স্টেজ শোতেও মাঝে মাঝে হাজির থাকতেন তিনি। এখনও ইউটিউবে দেখা যাবে, কিশোর গাইছেন, দর্শকাসনে রাজ কাপুর, লতা মঙ্গেশকরদের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ও বসে আছেন।
চারুলতার পর গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে গুপীর চরিত্রে কিশোর কুমারের কথাই ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। এমনকী ওই বিখ্যাত গানগুলোও নাকি কিশোরকে দিয়েই গাওয়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যস্ত কিশোর কুমার তখন সময় দিতে পারেননি। ফের দীর্ঘ বছর পর ঘরে বাইরে ছবিতে আবার ডাক পড়ে কিশোর কুমারের। এইখানেও সেই সৌমিত্র। এবং এই ক্ষেত্রেও কোনওরকম বাজনা ছাড়া খালি গলায় কিশোর গাইলেন বিধি বাঁধন কাটবে তুমি, বুঝতে নারি নারী কী চায়, চল রে চল সবে ভারত সন্তান। এবং যথারীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় সেই সৃষ্টি।
এক সান্ধ্য আড্ডায় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রয়াত পার্থ বসু এই লেখকে বলেছিলেন, ‘সঘন গহন রাত্রি’ গানটা সবার গলায় শুনো। তাহলে বুঝবে, যে স্বরগুলো দীর্ঘদিন স্বরলিপিতে আটকে ছিল, কেমন করে তা কিশোর–কণ্ঠে ধরা দিল।’
সত্যজিৎ–কিশোর কুমারের যুগলবন্দি রবি ঠাকুরকে ঘিরে শক্তপোক্ত শর্তাবলীর প্রাচীরকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের উঠোন হয়েছিল সর্বজনীন। সত্যি কথা বলতে কী, সেদিনের সেই শিল্প বিপ্লব না হলে হয়ত চেনাই যেত না ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’কে।
#######