রক্তিম মিত্র
গিল্ড কর্তারা ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। পরে আবার সেটা গিলতে হয়। আরও একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতে হয়। আর নইলে, চুপি চুপি বিবৃতি পাঠিয়ে রাখতে হয়। আগেরবারের মতো এবারের বইমেলাতেও তেমনটাই ঘটল। আগেরবার উদ্বোধনের তারিখ একদিন পিছিয়ে গেল। আর এবার উদ্বোধনের তারিখ একদিন এগিয়ে গেল। বলাই বাহুল্য, দুটোই বিশেষ কারও অনুপ্রেরণায়।
আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার বইমেলার উদ্বোধন হওয়ার কথা। বরাবর সেটাই হয়ে এসেছে। আগের বছরও তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। গিল্ড কর্তারাও ঘটা করে সেটাই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু উদ্বোধনের ঠিক কয়েকদিন আগে ঘোষণা হল, এবার উদ্বোধন হবে বৃহস্পতিবার। হঠাৎ কেন একদিন পিছিয়ে গেল? আসল কারণ হল মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। আর সেটা ঢাকতে আবোল তাবোল যুক্তি সাজানো হল।
এবারও তাই। বুধবার উদ্বোধন হওয়ার কথা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, কোনও একটি পঞ্জিকায় নাকি ওই দিনটা সরস্বতী পুজো। ওইদিন তিনি উদ্বোধন করতে পারবেন না। অমনি উদ্বোধন এগিয়ে এল। বুক ফুলিয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলা বলে প্রচারও করব। আবার বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মেনে উদ্বোধনের তারিখ এগিয়েও আনব, দুটো তো একসঙ্গে চলতে পারে না। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, একদিন এগিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়ায় বিরাট কিছু যায় আসে না। কিন্তু বারবার উদ্বোধনের দিন ঘোষণা করেও পিছোতে বা এগোতে হচ্ছে কেন? মুখ্যমন্ত্রী কী চাইছেন, ভাল করে জেনে নিলেই হল। তারপরই না হয় সাংবাদিক সম্মেলন ডাকবেন।
এবারও তিনি যথারীতি একগুচ্ছ বই লিখেছেন। সেই বইয়ের সংখ্যা নাকি এবার একশো ছাপিয়ে গেছে। সেইসব বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই ভাল। কিন্তু বইমেলার উদ্বোধনী মঞ্চে সেগুলো উদ্বোধন না করলেই নয়! যিনি বই ছাপেন, তিনিই আবার গিল্ডের সভাপতি। সেইসব বই মূলত কেনা হয় সরকারি টাকায়। সাধারণ পাঠক কতগুলো বই কিনেছেন আর সরকারি টাকায় সেইসব বই কত কেনা হয়েছে, তার কোনও হিসেব কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলে, আরও একটা বড়সড় কেলেঙ্কারি বেরিয়ে আসত।
বইমেলায় সবথেকে বড় জায়গা নিয়ে কাদের স্টল? বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। স্টলটি দেখলে মনে হবে যেন পুজোর প্যান্ডেল। বইমেলাতেও তাহলে পুজোর থিম এসে গেল! যার যেমন রুচি! সারাক্ষণ সেখান থেকে তারস্বরে গান বেজেই চলেছে। একসময় রাজ্যপালও গাড়ি বাইরে রেখে হেঁটে বইমেলায় ঢুকতেন। অথচ এই জমানায় একের পর এক ভুঁইফোড় নেতারাও গাড়ি নিয়ে দিব্যি ঢুকে যাচ্ছেন সেই স্টলের কাছে। বইমেলা চালাতে গেলে প্রশাসনকে দরকার, শাসকের আনুকূল্য দরকার। কিন্তু কোথাও তো একটা সীমারেখা টানতে হয়। স্বাভাবিক সৌজন্য আর দাঁত কেলানোর মধ্যে কোথাও তো একটা ফারাক থাকবে। আসলে, বইমেলা যেন অসহায় আত্মসমর্পণ আর দাঁত কেলানোর উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে।