স্বরূপ গোস্বামী
প্রায় সব কাগজেই খবরটা আছে। বিশ্বভারতীর আমন্ত্রণে সেমিনারে এসে বিক্ষোভের মুখে সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত। সব কাগজেই তাঁকে বিজেপি সাংসদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (একটি কাগজে লেখা হয়েছে বিজেপি সমর্থিত সাংসদ)।
এমন একটা সাধারণ বিষয় সব কাগজে একসঙ্গে কীভাবে ভুল লেখা হল, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। স্বপন দাশগুপ্ত বিজেপি নেতা হিসেবে পরিচিত, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তিনি বিজেপি অফিস থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, তিনি বিজেপির প্রতিনিধি হয়ে টিভি চ্যানেলের টক শো–তে যান, এটাও ঠিক। কিন্তু তিনি কখনই বিজেপি সাংসদ নন। অন্তত, কাগজে–কলমে তা লেখা যায় না।
স্বপন দাশগুপ্ত রাজ্যসভায় একজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ১২ জনকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করতে পারেন। যেমন রূপা গাঙ্গুলিকে অভিনেত্রী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল, তেমনি স্বপন দাশগুপ্তকে বিশিষ্ট সাংবাদিক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়টা কখনই রাজ্যসভার হুজ হু–তে লেখা থাকে না। সরকারিভাবে তাঁরা রাষ্ট্রপতি মনোনীত।
কংগ্রেস আমলেও লতা মঙ্গেশকার, শচীন তেন্ডুলকার বা রেখার মতো দিকপালকে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস কখনও তাঁদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহার করেনি। কিন্তু বিজেপি দলের লোকেদেরই রাষ্ট্রপতি মনোনীত তকমা দিয়ে সাংসদ বানাচ্ছে এবং তাঁদের দলীয়ভাবে ব্যবহার করছে। আর এইসব সাংসদরাও বোধ হয় বোঝেন না রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদ মানে কী? তাই রূপা গাঙ্গুলি মিছিলে হেঁটে বেড়ান। তাই সুব্রমণিয়ম স্বামী বা স্বপন দাশগুপ্তরা বিজেপি প্রতিনিধি হয়ে চ্যানেলে ভাষণ দেন।
অজ্ঞতা শুধু তাঁদের নয়। মূলস্রোত সাংবাদিকতাও একই দোষে দুষ্ট। এঁদেরকে বিজেপি সাংসদ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। বিভিন্ন রাজ্যে যাঁরা রাজ্যপাল আছেন, তাঁদের অধিকাংশই বিজেপির নেতা–নেত্রী ছিলেন। তাই বলে তাঁদের কি বিজেপির রাজ্যপাল বলা যায়? ঠিক তেমনি, রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও তাঁদের সেই দলের সাংসদ বলা যায় না।
দুঃখের বিষয়, একটি বাংলা সংবাদপত্রেও তাঁকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদ বলা হল না! সবাই বেমালুম বিজেপি–র সাংসদ বলে চালিয়ে দিলেন! এবং এ নিয়ে পরের দিন কোথাও কোনও ভ্রম সংশোধনও চোখে পড়ল না। অর্থাৎ, এটা যে ভুল, সেটাও কারও মনে হল না। বাংলা সংবাদপত্র জগৎ কারা চালাচ্ছেন? রিপোর্টার না হয় লিখলেন। তারপরেও তো আরও কয়েকটা ছাঁকনি থাকে। যে কোনও কপিই নিউজ ডেস্কে এডিট হওয়ার কথা। সেখানে বিষয়টা সংশোধিত হয়ে যাওয়ার কথা। তারপর থাকে প্রুফ পড়া। সেই ফাঁক দিয়েও গলে গেল (এটা তবু ক্ষমার চোখে দেখা যায়)। হেডিং করার সময়, পাতায় বসানোর সময় পাতার দায়িত্বে থাকা লোকেদেরও নজর এড়িয়ে গেল। পরেরদিন ছাপা হওয়ার পরেও কারও মনে হল না, এটা ভুল! একটা সংশোধনী দেওয়া দরকার!
কোনও একটি কাগজে এই ভুলটা হলে কিছু বলার ছিল না। হতেই পারে। তাই বলে মূলস্রোত সব কাগজেই একই ভুল! আসলে, ফেসবুক পোস্ট দেখে রাজনীতি সচেতন হতে গেলে বোধ হয় এখানেই বড় ফাঁক থেকে যায়! ফেসবুকের জমানায় সবাই রাজনৈতিক বোদ্ধা। অথচ, সাধারণ বিষয়গুলোই অজানা থেকে যায়। চ্যানেলেও যা, কাগজেও তা। একজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদকে যে দলীয় সাংসদ বলা যায় না, এই ন্যূনতম শিক্ষাটারই বড্ড অভাব।
সাধারণ একটা প্রতিবেদন। বাংলা সংবাদজগতকে বেআব্রু করে দিল। এই প্রতিবেদনের নিরিখে সংবাদমাধ্যম কি একবার আয়নার সামনে দাঁড়াবে? নাকি সবজান্তা সেজে প্রসঙ্গটাকে বেমালুম উড়িয়ে দেবে!
(মিডিয়া সমাচার। বেঙ্গল টাইমসের একটি জনপ্রিয় বিভাগ। মিডিয়া নানা বিষয় তুলে ধরে। সব ব্যাপারে সে সবজান্তা সাজে। কিন্তু মিডিয়া জগতের অনেককিছুই অজানা থেকে যায়। এই বিভাবে মিডিয়া বিভাগের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়। অনেক অজানা বিষয় যেমন উঠে আসে, তেমনি অনেক সুস্থ বিতর্কও চলে। পাঠকেরাও মিডিয়ার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরতে পারেন। রাজনীতি, সিনেমা, সাহিত্য, খেলা, ভ্রমণের পাশাপাশি মিডিয়া নিয়েও খোলা মনে চর্চা জারি থাকুক।)
**************
(বেঙ্গল টাইমসের শীত সংখ্যা। অনলাইন ম্যাগাজিন। উপরের লিঙ্কে ক্লিক করলেই খুলে যাবে। সহজেই পড়ে ফেলতে পারেন।)