সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
অযোধ্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ৫ জন বিচারপতি সর্বসম্মত হয়ে অযোধ্যার বিতর্কিত ওই জমিটি সরকারকে অধিগ্রহণ করে ৩ মাসের মধ্যে রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছে। আর সংখ্যালঘুদের অন্যত্র ৫ একর জমি দিয়ে মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আমার দৃষ্টিতে এই রায়ের মধ্যে “অস্বাভাবিকতা” কিছু থেকে থাকলেও,আমি এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলাম। বস্তুত আমার বিচারে এটা সুপ্রিম কোর্টের Verdict নয়, বরং একটা Resolution গোছের কিছু। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় কেই বঞ্চিত না করে,একটা সম্প্রীতির বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হল সুপ্রিম কোর্টের তরফে। বিশেষতঃ বিগত কয়েক বছর ধরে সারা দেশে যখন ধর্মের নামে হিংসা ও সংঘাত প্রায় সর্বত্রই চলছে তখন এইভাবে “সমাধান” দেওয়া আমার কাছে প্রত্যাশিতই ছিল।
ভাবুন তো, ১৯৯২ সালে যখন সারা দেষের মাত্র কয়েকটি রাজ্যে বিজেপির সরকার ক্ষমতায়, তখন প্রায় ২ লাখ লোক জড়ো করে যারা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ করেছিলো, আজকে দেশের মানচিত্রের প্রায় ৩/৪ অংশ যখন গেরুয়া, তখন অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমিতে “রামমন্দির” এর বিপক্ষে রায়দান হলে কী পরিস্থিতি হত সারা দেশে? শবরীমালার মন্দিরে সমস্ত বয়সের নারীদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে রায় দেওয়ার পরে সেখানকার পরিস্থিতি কতটা অগ্নিগর্ভ হয়েছিল, তা নিশ্চয় অনেকেরই স্মরণে আছে ? কিন্তু কেরলের বাম সরকার ততোধিক দক্ষতায় ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মান্ধদের সেই “তাণ্ডবলীলা” কে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছিল। এর জন্য কোনও প্রশংসাই মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এর জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু অযোধ্যা তো উত্তরপ্রদেশে! যেখানে রয়েছে ভয়ঙ্কর উগ্র হিন্দুত্ববাদী এক মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির শাসন। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই ধর্মীয় ও জাতপাতের হিংসা ও সংঘাত বারংবার উত্তরপ্রদেশ শিরোনামে এসেছে। তাই রামমন্দিরের বিরুদ্ধে রায়দান করলে তার পরিণাম কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
তবে একটাই প্রশ্ন আমার। এইভাবে সমঝোতার পথে হেঁটে সুপ্রিম কোর্ট যে রায়দান করল, তাতে বিচারটা কেমন হল আসলে ? যদি ধরে নেওয়া যায় রামায়ণে বর্ণিত রাম, অযোধ্যার রাজ্যপাট এবং রামমন্দির সত্যিই ছিল (যদিও Archeological Survey Of India এমন কোনও জলজ্যান্ত প্রমাণ দিতে পারেনি আজ পর্যন্ত) তাহলে ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের সময় (ভারতবর্ষের মুঘল শাসন প্রমাণিত সত্য এবং ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়) যে মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিলো তা গর্হিত কাজ এবং আজকে সংখ্যালঘুদের সেই মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫ একর জমি দেওয়াটা সমীচীন নয় কখনই। কারণ সেই রামমন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণটা আইনের চোখে অপরাধই।
অন্যদিকে যদি রাম, অযোধ্যার রাজ্য আর রামমন্দির—সবটাই কাল্পনিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস হয়, তাহলে যে মসজিদটার অস্তিত্ব ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ছিল, তাকে ধুলিসাৎ করার নেপথ্যে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত, তাদের অপরাধও সীমাহীন এবং আইনের চোখে তাদেরও সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। তাদের সঠিক বিচার কবে হবে, সেইটাই এখন দেখার। মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ৫ জন বিচারপতি কিন্তু মেনে নিয়েছেন ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় “বাবরি মসজিদ” ধুলিসাৎ করা ভারতীয় সংবিধান অনুসারে আইনের দৃষ্টিতে একটি ঘৃণ্য ঘটনা।
হিন্দু–মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মানভঞ্জন করে আদপে মসজিদ ধুলিসাতের কুচক্রী এবং অপরাধীরা নিস্তার পেয়ে যাবে না তো ?
বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ পাহাড় সংখ্যা।
এই ছবিতে ক্লিক করলেই অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারেন।