ড. অরিন্দম অধিকারী
ইথিওপিয়া। আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। ৯ কোটি ৬৭ লক্ষ ৬৯ হাজারে বহু ধর্ম, ভাষাগোষ্ঠীর দেশ ইথিওপিয়া। ১৯৯১ এ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে ধর্ম–জাতি–ভাষা উগ্র জাতীয়তা ও মার্কিনী ষড়যন্ত্র সারা দুনিয়াজুড়ে ছোট ছোট রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ইথিওপিয়াও এই রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেনি। ১৯৯৩ সালে আরও একবার নতুন করে লোহিত সাগরের সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইথিওপিয়াকে। জন্ম হয় নতুন রাষ্ট্র ইরিট্রিয়া। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত দখলের আগ্রাসী মানসিকতা যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। ১৯৯৮ সালের মে থেকে ২০০০ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুই দেশ একে অন্যকে জব্দ করতে কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ করেছে। না, শান্তি ফিরে আসেনি।
কুড়ি বছর এক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে শান্তির বাণী শোনানোর জন্য। সত্তর হাজার মানুষের জীবন গেছে। আরও কত মানুষ চিরদিনের জন্য পঙ্গু, অথর্ব হয়ে বেঁচে আছেন। অর্থনীতির ধাক্কা তো আছেই, সমাজজীবনও যেন টালমাটাল। আলোচনার টেবিলে চিরশত্রু ইরিট্রিয়াকে এনে শান্তির পুনর্গঠনের নতুন ইতিহাস রচনা করলেন আবি আহমেদ আলি। পূর্ব আফ্রিকা–সহ গোটা আফ্রিকা মহাদেশের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। ইথিওপিয়ান পিপলস রেভুল্যুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান। ইথিওপিয়ার বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী।
লড়াকু জীবন, ধর্ম নিরপেক্ষতার অতন্দ্র প্রহরী। গণতন্ত্রে বাম মতাদর্শে নিরন্তর অনুশীলনের বৈপ্লবিক নেতা আহমেদ আলি। জন্ম ইথিওপিয়ায় দরিদ্র পরিবারে। জন্মসূত্রে বাবা মুসলিম, মা অর্থোডক্স খ্রিশ্চান। ধর্ম নিরপেক্ষতা যেন তাঁর লাল রক্তের হিমোগ্লোবিনে হিল্লোলিত প্রাণ। ২০১৮–র এপ্রিলে ক্ষমতায় আসার পর দেশের মধ্যে চলতে থাকা অঘোষিত জরুরি অবস্থার অবসান ঘটিয়েছিলেন। বিরুদ্ধমতের নেতাদের জেল থেকে মুক্ত করেছিলেন। সাংবাদিকদের দিয়েছিলেন সংবাদ পরিবেশনের অবাধ স্বাধীনতা। দমবন্ধ করা অবস্থা থেকে একটু একটু করে এল খোলা হাওয়া। রাজনৈতিক চেতনার হাতেখড়ি সেই ১৩ বছর বয়সে। জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। কে ম্যান্ডেলা, কেন তিনি কিংবদন্তি, বর্ণবৈষম্য কী, ওই কিশোরের পক্ষে সমস্যার গভীরে গিয়ে বোঝার কথাও নয়। সে নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছিল। জেল থেকে ম্যান্ডেলার মুক্তির ঘটনা আরও অনেকের মতো ওই ছোট্ট ছেলেটিকেও নাড়া দিয়েছিল। ওই বয়সে ম্যান্ডেলার ছবি দেওয়া টি শার্টটি ছিল তাঁর সবথেকে প্রিয়। পথ চলার যেন নতুন এক দিশা খুঁজে পেলেন।
প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না থেকে তার উল্টোপথেই হেঁটেছেন। প্রগতির পথ, শান্তির পথ। ফলস্বরূপ, নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ৩০০ টি নমিনেশনের মধ্যে থেকে ২০১৯ এর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য আলি আহমেদের নামই ঘোষণা করলেন। দেশের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিশ্চানদের গৃহযুদ্ধ থামালেন। প্রতিবেশী ইরিট্রিয়ার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক স্থাপনে অনন্য নজির গড়লেন। আদ্দিম আবাবা ও আসমোরার মধ্যে মাত্র ৫০ মিনিটের যাত্রাপথ খুলে গেল দীর্ঘ ২৫ বছর পর। রাজৈতিক জীবনাদর্শ, প্রতিবেশীসুলভ সংবেদনশীল মন আফ্রিকা–সহ ইথিওপিয়াকে নোবেল এনে দিল।
পুরস্কার মাঝে মাঝেই তার ঠিকানা হারিয়ে ফেলে। ভুল হাতে পৌঁছে যায়। তাই, যুদ্ধবাজের হাতেও কখনও কখনও পৌঁছে গেছে শান্তির নোবেল। এবার অন্তত পুরস্কার তার সঠিক ঠিকানা চিনে নিতে ভুল করেনি।