কুণাল দাশগুপ্ত
আমাকেও যে হাতে কলম তুলে নিতে হবে, তা কোনওদিন আমার কল্পনার চৌকাঠ পর্যন্ত আসেনি। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই যন্ত্রণামাখা লেখাটা দেবরাজের হাতেই তুলে দেব। কিন্তু পরে মত পরিবর্তন করলাম। ভাবলাম, পরমপিতা বহ্মার কাছেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট লেখাটা পাঠিয়ে দেব। কারণ, একমাত্র তিনিই ওপেন থেকে গোপন– সব কম্মরই হদিশ রাখেন।
কারিগরী বিদ্যা আয়ত্বে আনার পর থেকেই দেখেছি, আমার পুজোর দিন মর্ত্যের আকাশে ঘুড়ির ঘনঘটা। আমার প্রতীক কবে থেকে ঘুড়ি হয়ে উঠল, কেনই বা হয়ে উঠল, আমি নিজেও জানি না। কখনও কখনও সূর্যদেবকেও ব্যাজারমুখে বলতে শুনেছি, আকাশ যদি পেটকাটি চাঁদিয়ালেই ঢাকা থাকে, তাহলে আমি উকি দেব কীভাবে?
সময় বদলে গিয়েছে। শরীরে রক্ত না থাকলে যেমনটি হয়, মর্ত্যের আকাশও তেমন ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছে। ফাঁকা আকাশেই দু–চারটি ঘুড়িএলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাস, এই পর্যন্তই। লাটাই, মাঞ্জা, শুরকি, ভোকাট্টা–এসব শব্দগুলো আস্তে আস্তে অভিধান থেকেও হারিয়ে যাবে। তবে ঘুড়ি আজও ওড়ে। কে কোথায় উড়ে বেড়ায়, কোথাও না কোথাও মাপা হয়। লাটাই আজও আছে। পুলিশের লাটাই নেতার হাতে, নেতার লাটাই ব্যবসায়ীর হাতে।
বস্তুতপক্ষে যারা আমার পুজো করে, তাদের নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আমার আজও রয়েছে। প্রতিটি দেবদেবীর পুজোতেই নিয়ম করে মাইকে গান বাজানো হয়। তবে আমারটা একটু অন্যরকম। এখানে শারদ বা দীপাবলির মতো সম্মান বা পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই। সারা বছর হুল্লাট মার্কা গান শুনে বিশেষ দিনগুলিতে ভদ্দরলোকের মেক আপ নিয়ে বাছা বাছা কয়েকটা গান শোনার চলও নেই। ‘বুদ্ধিজীবী’ ইমেজ বজায় রাখার দায় নেই। একসময়ে ‘চাহে কোই মুঝে জঙ্গলি কহে’ বেজেছে। বেজেছে ‘রূপ তেরা মস্তানা’, পরে ‘জয় জয় শিবশঙ্কর’। কাল তো ‘মেরে নয়না সাওনা ভাদো’–ও শোনা গেছে। একেই বোধ হয় বলে মহাকালের বিচার। সে ঠিক ছেঁকে নেয়, বেছে নেয়। আদিখ্যেতাহীন খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অকৃত্রিমতা আমি চেটেপুটে খেতাম। হ্যাঁ, আজও খাই। কিন্তু আর কতদিন?
এক অশনি সঙ্কেত আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি। আশঙ্কা এই কারণে, মর্ত্যে মানুষের ঘরে তো আমার পুজো হয় না। যেমনটা লক্ষ্মী–সরস্বতীর হয়। যন্ত্রের ব্যবহার যেখানে রয়েছে, যেমন কল কারখানা ইত্যাদি জায়গায়, কেবলমাত্র সেইখানেই আমি পূজিত হই। মর্ত্যে যে স্থানে আমার ভক্ত সবথেকে বেশি, সেটা হল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু ওই ভূখণ্ডে একে একে নিভিছে দেউটি। বন্ধ হচ্ছে কল কারখানা। শিল্পপতিরা টা–টা করছে। আগামী দশ–পনেরো বছর পর হয়তো মরুভূমি হয়ে যাবে রাজ্যটা। কারখানা যদি নাই থাকে, আমার পুজো হবে কোথায়! বেকারত্বের নরক যন্ত্রণায় স্বর্গে বসেই ভোগ করতে হবে আমাকে।
পরমপিতার কাছে আমার একমাত্র জিজ্ঞাস্য, পাপ তো তেমন একটা করিনি। আপনি বিলক্ষণ জানেন, মনসা দেবী প্রায় জোর করে বেহুলা–লখিন্দরের লোহার বাসরঘরে একটা ছোট্ট ছিদ্র করিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে দিয়ে। যাতে কেবলমাত্র সাপ ঢুকতে পারে। এটাই কথিত আছে। কিন্তু ওই ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে বেহুলা এবং লখিন্দর ঢুকল কীভাবে? আর আমি তো তাদের মাঝে রেখে বাসরঘরটা বানাইনি। এটা একটি নির্ভেজাল মিথ্যে অভিযোগ, অপপ্রচার। আপনি উদ্যোগ নিন। নয়তো আগামীদিনে ‘চল চল চল মেরে সাথী, ও মেরে হাতি’ আমার জাতীয় সঙ্গীত হবে, একথা জোর দিয়ে বলতে পারি। কারণ, ও ছাড়া আমার কথা ভাবার সময় হবে না মর্ত্যের আর কোনও প্রাণীর।