মহম্মদ আলতাফ। প্রতিবছর শাল নিয়ে আসেন কাশ্মীর থেকে। জড়িয়ে গেছেন কলকাতার সুখ দুঃখের সঙ্গেও। শীতের কলকাতায় তিনিও এক অতিথি। সেই জীবনযাপন ও অনুভূতি উঠে এল স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে। তাঁর বকলমে সেই চিঠি লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী।।
প্রিয় ইয়াসমিন,
কুড়ি বছর হল, আমাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তোমাকে কখনও চিঠি লিখিনি। আসলে, যে বছর আমাদের বিয়ে হল, তার আগের বছরই আমাদের শ্রীনগরের বাড়িতে ফোন এসেছে। ফোন এলে স্বাভাবিক নিয়মেই চিঠি লেখা কমে যায়। এসটিডিতে তখন লাইন পাওয়াই যেত না। তবু কলকাতার বিভিন্ন টেলিফোন বুথ থেকে ডায়াল করে যেতাম। যদি লাইন পেয়ে যাই। লাইন পেতাম, একটু পরেই কেটে যেত।
এখন তো অনেক সুবিধে। যখন ইচ্ছে, তখনই মোবাইলে কথা বলা যায়। এই তো, আজ সকালেই তোমার ছোট মেয়ে তুবা দুবার ফোন করল। তোমার নামে যত অভিযোগ, সে আমাকেই জানাবে। হয়ত কোনও লোকের বাড়িতে শাল দেখাচ্ছি। হয়ত দরাদরি চলছে, ও কিছুই বুঝতে চায় না। অন্য প্রান্ত থেকে বকবক করেই যায়। আবার ফোন না ধরলেও মুখ ভার হয়ে যায়। ওর ওপর তো রাগ করা যায় না। ক্লাস সিক্সে পড়া ওই বাচ্চা মেয়ে বুঝবেই বা কী করে! তোমার বড় মেয়ে সফুরা অবশ্য বোঝে। ও তো ছোট থেকেই শান্ত।দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়ে গেল, তাই না! ও যে ডাক্তারি পড়ছে, মাঝে মাঝে বিশ্বাসই হয় না। মাহরিনের পরীক্ষা তো হয়ে গেছে। তোমার মেজো মেয়েটি কী নিয়ে পড়বে, কিছু ঠিক করেছো ? ও তো কিছুটা লাজুক। নিজের কথা মুখ ফুটে বলতে চায় না। তুমি কথায় কথায় একটু জেনে নিও প্লিজ। আমি আর কতটুকু সময় থাকি! তুমিই তো এদের সব। আমি চাই না আমার ইচ্ছে ওদের উপর চাপিয়ে দিতে। ওরা নিজেদের মতো করেই বড় হোক। ওদের যেন শালের বোঝা নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরতে না হয়।
একসময় খুব দুশ্চিন্তা হত। আব্বুজান-আম্মি খুব চিন্তায় থাকত। ছেলে মাসের পর মাস বাইরে থাকলে কার না চিন্তা হয়! কলকাতায় পৌঁছেই টেলিগ্রাম পাঠাতাম। ওরা কিছুটা স্বস্তি পেত। এদিকে ওদের জন্য আমার দুশ্চিন্তা থেকেই যেত। তখন কাশ্মীর কতটা অশান্ত ছিল, তা তো তুমি ভালই জানো। সবসময় গুলি আর গ্রেনেড। কখনও জঙ্গিরা গুলি ছুঁড়ছে। আবার কখনও জঙ্গি ভেবে মিলিটারিরা গুলি ছুঁড়ছে। দুদিকেই ছিল বিপদ। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করত, ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।’
জানো, বাংলায় সত্যজিৎ রায়ের একটা উপন্যাস আছে – ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর। আমাদের ভূস্বর্গ একসময় সত্যিই ভয়ঙ্করই ছিল। এখন অবশ্য কাশ্মীরের পরিস্থিতি অনেক ভাল। কথায় কথায় আর গুলি চলে না। রোজ সকালে উঠে ভাবতে হয় না, কার মৃত্যু সংবাদ শুনব। আতঙ্কের সেই আবহ অনেকটাই কেটে গেছে। তাই কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি। এবার গরমের সময় কাতারে কাতারে পর্যটন এসেছে, তা তো দেখেই এসেছি। শুনছি, শীতেও নাকি পর্যটকের ঢল নেমেছে। এটাই তো চেয়েছিলাম। ওই বরফে ঢাকা পাহাড়, ডাল লেক, ওই শিকারা আর হাউজবোট। সেইসঙ্গে ওই নিষ্পাপ মুখগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে যায়। তখন বলতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে তা এখানেই।
কলকাতা শহরটাও ভারী সুন্দর। একটা একটা প্রাণের স্পর্শ আছে। সবাই মিলেমিশে থাকার একটা পরিবেশ আছে। যখন কাশ্মীরে থাকি, তখন এই শহরটাও আমাকে খুব টানে। হবে না কেন? নভেম্বর থেমে মার্চ, বছরে প্রায় পাঁচ মাস তো এখানেই কাটে। এটাও এখন দ্বিতীয় ঘর হয়ে গেছে। অথচ, তিরাশি সালে প্রথমবার যখন এসেছিলাম, খুব মন খারাপ করত। সবে বি কম পাস করেছি। চাকরি-বাকরি জুটছিল না। আমার এক বন্ধু ছিল। তার নামও আলতাফ। সে বলল, চল, কয়েকমাস কলকাতায় কাটিয়ে আসবি। ভাল ব্যবসা হবে। ঘোরাও হবে।’ সাত পাঁচ না ভেবেই চলে এলাম। তখনও ব্যবসার কিছুই বুঝি না। এত শাল সঙ্গে নিয়ে আসা, সঙ্গে সোয়েটার, টুপি, চাদর, জ্যাকেট। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিক্রি করা। এমনও দিন গেছে, একটা শালও বিক্রি হয়নি। একেবারে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছি। সেদিন খুব মন খারাপ হয়ে যেত। মনে হত, কী হবে এখানে থেকে। তার থেকে বরং ফিরে যাই। কিন্তু আব্বু-আম্মির কথাও মনে পড়ে যেত। আমাকে ওঁরা বড় করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এবার আমার ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। তাই মাটি কামড়ে পড়েছিলাম। সকাল থেকে সন্ধে, এপাড়া, ওপাড়া ঘুরে বেড়াতাম। কত নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হত। এভাবেই দেখতে দেখতে ৩২ বছর কেটে গেল। এখন আর শুধু চেনা নয়, প্রায় আত্মীয়তাও হয়ে গেছে। জানো।, বিয়েবাড়িতে লোকে এখন আমাকে নেমন্তন্নও করে!
নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এবার এথনও তেমন জাঁকিয়ে শীত পড়েনি। তবে অর্ধেক মাল বিক্রি হয়ে গেছে। যা বাকি আছে, আশা করছি, এই ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে যাবে। এখন তো আবার অনলাইন শপিংয়ের যুগ। কিছু এজেন্সিও কিনে নিয়ে যায়। প্রতিবারেই ডিসেম্বরের মধ্যে মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। তবু আরও দু-আড়াই মাস থাকতে হয়। কারণ, বিভিন্ন দোকানে ধারে মাল দিতে হয়। কিছু চেনা-জানা বাড়িতেও ইনস্টলমেন্টে টাকা দেয়। জানু্য়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিস্তির সেই টাকা আদায় করতে হয়। প্রথম প্রথম খুব সমস্যা হত। লোক চিনতে ভুল হয়ে যেত। এখন বুঝতে পারি, কে টাকা দেয়, কার টাকা পেতে সমস্যা হয়। সময় কতকিছু শিখিয়ে দেয়! এই কলকাতার রাস্তাঘাট এখন আমি কলকাতার লোকেদের থেকেও ভাল চিনি। তাই আমি যতটা শ্রীনগরের, ততটাই কলকাতার।
তুমি নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনো। তাঁর একটা মজার গল্প ছিল – কাবুলিওয়ালা। তোমাকে বোধ হয় গল্পটা বলেছি। রহমত নামে এক কাবুলিওয়ালা। সে পাড়ায় পাড়ায় হিং, আখরোট, কাজু, কিসমিস এসব বিক্রি করে বেড়াতো। মিনি নামে ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়েকে দেখে তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যেত। মেয়েটি জিজ্ঞেস করত, ‘ও কাবুলিওয়ালা, তোমার ওই ঝুলিতে কী আছে ?’ রহমত জবাব দিত, ‘হাতি আছে।’ গল্পটা নিয়ে একটা সিনেমাও হয়েছিল। তখন বাংলা কিছুই বুঝতাম না, তবু সিনেমাটা বুঝতে কোনও অসুবিধেই হয়নি। বেশ কয়েকবার সিনেমাটা দেখেছি। এই তো সেদিনও টিভিতে দিয়েছিল। চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে যেই চোখে পড়ল, থমকে গেলাম। পুরো ছবিটা দেখে, তবেই উঠলাম।
আসলে, ওই রহমতের সঙ্গে আমারও কোথাও একটা মিল আছে। সে বিক্রি করত কাজু, কিসমিস। আর আমি বিক্রি করি শাল, শোয়েটার। তার মতো আমাকেও এ বাড়ি, সে বাড়ি যেতে হয়। অনেক বাচ্চা মেয়েকে দেখে নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। রহমতের পকেটে থাকত ভাঁজ করা একটা কাগজ, মেয়ের হাতের ছাপ আঁকা। আমার হাতে থাকে মোবাইল, মেয়েদের ছবি লোড করা। তোমার ছবি, আব্বা-আম্মির ছবিও লোড করা আছে। যখন একা থাকি, তখন উদাস মনে মোবহাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিন মেয়ের ছোট ছোট দুষ্টুমি ও আবদারগুলো মনে পড়ে যায়। চোখ ছলছল করে ওঠে। মন চলে যায় সুদূর কাশ্মীরে।
আমি এবার উঠেছি ইলিয়ট রোডের একটা বাড়িতে। আমার অনেক বন্ধুই এই সময়টায় শাল বিক্রি করতে আসে। তারা একেক বছর একেক শহরে যায়। আমি কিন্তু ৩২ বছর ধরে এই কলকাতাতেই আসি। এই শহরটার সঙ্গে কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গেছি। আরও অনেকে আছে, যারা কলকাতায় এলেও একেকবার একেক অঞ্চলে ডেরা বাঁধে। আমি কিন্তু বারাবর পার্ক সার্কাস বা আশেপাশেরে এলাকাতেই থাকি। এখানে এত চেনাজানা হয়ে গেছে, নিজেকে বাইরের লোক বলে মনেও হয় না। এখানকার মানুষও আমাকে চিনে গেছে। বাইরের লোক বলে মনে করে না। কে কোন জিনিস পছন্দ করে, বেশ ভাল বুঝতে পারি। কোন লোক ধার নিলে শোধ করতে চায় না, এতদিন এটাও বুঝে গেছি। কেউ আছে, খুব দরদাম করে। কেউ যা দাম বলব, তাই দিয়ে দেবে। কেউ একটা দেখেই পছন্দ করে ফেলে। কেউ বলে, আপনিই বেছে দিন, যেটা দেবেন, সেটাই নেব। কেউ প্রচণ্ড খুঁতখুতে, যতই দেখাও, পছন্দ হয় না। কেউ বলে, এটা যে কাশ্মীরের শাল, তার প্রমাণ কী? কেউ কাশ্মীরের লোক শুনলেই মনে মনে ভাবত, জঙ্গি নয় তো ? কেউ কেউ বলে, আপনি কাশ্মীরের লোকই নন, সবসময় তো এখানেই দেখি। কত বিচিত্র লোকজন। জানো, আগে খুব রাগ হত। এখন বয়স বাড়ছে তো। এখন আর রাগ করি না। হেসে বোঝানোর চেষ্টা করি। নিজেরও খুব হাসি পায়।
সাইবা নামে মেয়েটার কথা তোমাকে বলেছি। কড়েয়া রোডে থাকে। আমাদের সাফুরার বয়সীই হবে। খুব মিস্টি মেয়ে। ও যখন আরও ছোট ছিল, তখন বলত, ‘আপ হামে কব কাশ্মীর লে জায়েঙ্গে? ইতনা খুবসুরত জাগা ছোড়কে আপ ইঁহা কিঁউ আতে হ্যায়?’ অনেকবার ইচ্ছে হয়েছে ওকে নিয়ে যাই। কিন্তু কোনওবারেই নিয়ে যাওয়া হয়নি। এখন অবশ্য অনেক বড়। এখন মাঝে মাঝে বলে, ‘আঙ্কেল, আপ কো তো হামেশা ইঁহা দেখতি হুঁ। আপ ইঁহা র্যা হে যাইয়ে। উঁহা বহত গোলি চলতি হ্যায়। আপ আন্টি কো লে কে ইঁয়া চলে আইয়ে।’।
আমার ইলিয়ট রোডের ঘরটা বেশ বড়। তিনটে ঘর। আসার আগেই অমৃতসর ট্রান্সপোর্টে বুকিং করে এসেছিলাম। যেসব মাল এসেছে, সেগুলো বোঝাই করা ছিল দুটো ঘরে। একটা ঘরে আমি একা। কিছু মাল দোকানে দিয়ে দিই। কিছু মাল নিয়ে ঘুরি বাড়িতে বাড়িতে। বেরোই সেই সকাল আটটায়। আড়াইটে-তিনটে নাগাদ ফিরে যাই। কবে, কোথায়, কত মাল বিক্রি হবে, একটা আন্দাজ হয়ে গেছে। কোনওদিন হয়ত মাল নিয়ে বেরোনোর দু ঘণ্টার মধ্যে সব মাল শেষ। সেদিন মনটা বেশ ফুরফুরে থাকে। আবার কোনও বাড়িতে, কোনও বাচ্চা মেয়েকে দেখে হয়ত নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তাকে একটা সোয়েটার বা জ্যাকেট উপহার দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সবাই তো উপহার নিতে চায় না। ভাবতে পারে, হয়ত কোনও মতলব আছে। তখন ইচ্ছে করে দাম কমিয়ে বলি। যেন তার বাবা-মা নিশ্চিন্তে শোয়েটারটা নিতে পারে। ওরা যখন ওই শোয়েটার পরে স্কুলে বা বেড়াতে যায়, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ওই যে বললাম, কাবুলিওয়ালার রহমতের সঙ্গে আমারও অনেক মিল আছে।
বিকেল হয়ে আসছে। ওখানে নিশ্চয় খুব অন্ধকার নেমে গেছে। ঠান্ডা বাড়ছে, আব্বু-আম্মির যত্ন নিও। আমার ছোট্ট তুবা এখন নিশ্চয় পড়তে বসেছে। ওকে খুব মিস করছি। আর তো মাত্র দুটো মাস। তারপরই আমি পৌঁছে যাব। আব্বু-আম্মিকে কখনও কলকাতায় ঘোরানো হয়নি। খুব আক্ষেপ হয়। তোমাকে একবার এনেছিলাম, কিন্তু মেয়েরা দেখলই না তাদের বাবা কোথায় থাকে। সামনের শীতে, তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে আসব। মেয়েদের লেখাপড়া আছে। পুরো সময় থাকতে পারবে না, জানি। তবু দিন পনেরো থাকতেই পারো। তবে তোমার দুই মেয়ে যা নেট ঘাঁটে, কী জানি, হয়ত নেটেই কলকাতাকে চিনে নিয়েছে। হয়ত ওরাই আমার গাইড হতে পারে। পরেরবার আসার জন্য এখন থেকেই মনে মনে তৈরি হও। ভাল থেকো।