সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জনাদেশ পেয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য কেন্দ্র সরকারে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরের ওপর থেকে ঐতিহাসিক ৩৭০ ধারা এবন তার অন্তর্ভুক্ত ৩৫এ ধারা রদ করলেন। জম্মু ও কাশ্মীরকে অঙ্গরাজ্যের পরিবর্তে তিনি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে দিলেন। এবং লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে পুরোটাই কেন্দ্রের দখলে রাখলেন। উদ্দেশ্য একটাই, কাশ্মীরের এই পুনর্গঠনের ফলে দেশ নাকি সন্ত্রাসবাদ মুক্ত হবে। কেন্দ্রের তথা ভারতীয় সেনার নজরদারিতে সীমান্তে জঙ্গি আক্রমণ বন্ধ হবে। কাশ্মীরে নাকি শান্তি ফিরে আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যের মধ্যে আপাততঃ কোনও ভুল কিছু নেই, কারণ দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই চায় সুখে-শান্তিতে বাস করতে।কেউই চায় না,প্রভাতে তার ঘুম ভাঙুক বোমার তীব্র শব্দে বা বোমারু বিমানের আকাশপথে টহলদারির শব্দে,যা কাশ্মীরের মানুষের বিগত কয়েক বছর ধরে দেখে দেখে এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। তাঁরাও কি মনে প্রাণে আদৌ চান ওই মৃত্যু উপত্যকার মধ্যে,ওই বধ্যভূমির মধ্যে দিনের পর দিন,মাসের পর মাস এইভাবে বেঁচে থাকতে? নিশ্চয় না। তাঁরাও শান্তি চান। ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের অধিবাসীদের মতো তাঁরাও চান পরিবার নিয়ে, আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকতে এবং জীবনের প্রয়োজনে জীবিকা নির্বাহ করতে।
কিন্তু কথাটা হল, এই ৩৭০ ধারা রদ করার সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হবে? দেশের মানুষ যেভাবে এই সিদ্ধান্তের পরে কিছু না ভেবেই আবেগে ভেসে গিয়ে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, তা দেখে আমার “নোটবন্দী”র কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। এইরকম ভাবে আবেগের বশেই সেদিন “নোটবন্দী” কে দু হার তুলে সমর্থন করেছিলেন সারা দেশের সিংহভাগ মানুষ। দিবারাত্র ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার লাইনে ঘণ্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে, অমানুষিক পরিশ্রম করে টাকা তুলেও তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়েই বলেছিলেন, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে “কালো টাকা” উদ্ধার হবেই। জম্মু ও কাশ্মীরের ইন্দো–পাক সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হবে। জাল নোটের কারবার বন্ধ হবে। দেশের পক্ষে এতগুলো হিতকর সিদ্ধান্তের জন্য সেই মানুষেরা কয়েকদিন বা কয়েকমাস এই অমানুষিক পরিশ্রম সহ্য করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না।
কী দেখা গেল সেই “নোটবন্দি”র ফলাফল ? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশ করল “নোটবন্দি”র ফলে প্রায় ৯৯% ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট সরকারের কাছেই ফিরে এসেছে। অর্থাৎ যদি “কালো টাকা” থেকেও থাকে, সেটা শুধু “সাদা” হয়েছে। আর কিছুই নয়। সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হওয়া তো দূরের কথা, বরং আরও বেড়েছে। উরি, পুঞ্চ, রাজৌরি এবং সর্বশেষ পুলওয়ামাতে ভয়াবহ জঙ্গি আক্রমণই তার প্রমাণ। প্রায় ৩০০ সেনা “শহীদ” হয়েছিল “নোটবন্দি”র পরে। বাজারে ২০০০ টাকার নোট আমদানি হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সীমান্তে শুরু হয়ে গেল জাল নোট ছাপানো এবং ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষ তখনও আবেগে ভাসছেন! ‘আহা, এত বড় সিদ্ধান্ত আর কোনও প্রধানমন্ত্রী নিতে পেরেছেন অতীতে?’ কিন্তু মানুষ দেখছেন না এই ‘তুঘলকি সিদ্ধান্ত’ ১০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কার্যত ধ্বংস হয়েছিল এই নোটবন্দির ফলে। অর্থনৈতিক সূচক কীভাবে আকাশ থেকে মাটিতে এসে ঠেকেছিল। শেয়ারবাজারে নেমেছিল ধস। আর সবচেয়ে বড় কথা, খোদ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার আজ পর্যন্ত জানাতে পারলেন না, নোটবন্দির ফলাফল। কত কালো টাকা উদ্ধার হল, তা আজও কেউ জানে না। উপরন্তু দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ, যাঁরা এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন, তাদের সকলকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘ভারতবিরোধী’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হল। পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নিদান দেওয়া হল। আর নিজেদের মুখ বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার নির্বাচনী প্রচার থেকে ‘নোটবন্দি’কে একেবারেই বাদ দিয়ে দিলেন। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্নাটক-কোনও রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেই “নোটবন্দি” জায়গা পায়নি শাসক দলের নির্বাচনী প্রচারে।
আজকেও সেই ব্যাপারটাই ফিরে ফিরে আসছে। কাশ্মীর ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সংবিধানের এই ৩৭০এ ধারার মাধ্যমেই। সেই ধারাকে উচ্ছেদ করা আদপেই সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করারই নামান্তর।৩৫০ এর বেশি আসন জিতে প্রধানমন্ত্রী দেশের এই সংবিধানের ওপরেই চরম আঘাত হানলেন। তিনি দাবি করছেন কাশ্মীর এই ৩৭০এ ধারা বিলোপের পরে শান্ত হয়েছে। অথচ তিনি ৫ মিনিটের জন্য কাশ্মীর থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার সাহস দেখাতে পারছেন না ! গোটা উপত্যকাকে ঘিরে রেখেছেন সশস্ত্র সেনাবাহিনী দিয়ে। কেন? কাশ্মীরে তো শান্তি বিরাজমান। আসলে কারণ একটাই। কাশ্মীরবাসী ক্ষোভে ফুঁসছে। তাদের দমিয়ে রাখতেই রাষ্ট্রের হাতিয়ার তার এই সেনাবাহিনী। কাশ্মীরে টেলিভিশন, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। গোটা উপত্যকা কার্যত বিছিন্ন।
আমার প্রশ্ন হল, এইভাবে যা তিনি করলেন সেই ৩৭০এ ধারার অন্তর্গত অরুণাচল প্রদেশ বা নাগাল্যান্ডেও তিনি সেটাই করে দেখাতে পারবেন? হয়তো পারবেন না। কারণ সেখানে নাগা বা মিজো জঙ্গি থাকলেও বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে জঙ্গিরা শুধুমাত্র একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের।তাই কাশ্মীরের নীতি তিনি অরুণাচল,নাগাল্যাণ্ড বা মিজোরামে কিছুতেই প্রয়োগ করতে পারবেন না। আচ্ছা, জম্মু,কাশ্মীর এবং লাদাখের মধ্যে কাশ্মীর তো সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ভাবে অশান্ত ?? তবুও কাশ্মীর কে কেন জম্মুর সঙ্গে রেখে লাদাখ কে পৃথক করলেন? তিনি তো কাশ্মীর কেই পৃথক করে দিতে পারতেন ? কারণ একটাই। তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন এই সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীরের মানুষের ক্ষোভ চরমে পৌঁছবে। আর তাই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কাশ্মীরে শান্তি ফেরানোটা হবে ২০২৪ সালে তাঁর নির্বাচনের ইস্তেহার। কী জানি, তখন হয়ত হাত থেকে অন্য কোনও লুকোনো তাস ফেলতে হবে। কারণ, উন্নয়ন বা কাজ নিয়ে ভোটে যাওয়ার সৎ সাহস মোদিবাবুদের নেই। তাঁদের হিন্দু–মুসলিম বা ভারত–পাকিস্তানের জিগির তোলা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
মানুষ শান্তিতে খেয়ে, পরে বেঁচে থাকলে কেউই যুদ্ধ করতে চায় না। যুদ্ধ তো অশিক্ষা, দারিদ্র্যেরই ভয়ঙ্কর প্রকাশ। যুদ্ধ মানেই প্রাণহানি,সম্পত্তিহানি। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও যুদ্ধই কি কোনও সমস্যার সমাধান করেছে কখনও ? বরং যুদ্ধের ফলে দারিদ্র্য,অপুষ্টি, বেকারত্ব এইসব সমস্যা আরও উত্তরোত্তর বেড়েছে। অর্থনীতি ধূলিস্যাৎ হয়ে পড়েছে।
কাশ্মীরবাসীও শিক্ষা চায়। তারা চাকরি চায়। পেটের ভাত চায়। শান্তিতে বেঁচে থাকতে চায়। তারা ভারতবর্ষের মূল স্রোতে ফিরতে চায় প্রতিদিনই। তাদের “সন্ত্রাসবাদী” আখ্যা দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রেখে তাদের অবস্থার কোনও উন্নতি তো হবেই না। উপরন্তু আরও জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রী একটু ভাবুন এই “মহাসত্য” গুলো ।
আপনি নোটবন্দি করেছিলেন সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে, এবং চুড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন। ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ করে দেশের সংবিধানের ওপর আঘাত হেনে কাশ্মীরবাসীর ক্ষোভকে দাবানলে পরিণত করে শান্তি ফেরাতে পারবেন কি?