সঙ্গীত কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের জীবনের অনেক অজানা কথা উঠে এল একটি সাক্ষাৎকারে। সেই সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হল বেঙ্গল টাইমসের পাঠকদের জন্য।।
প্রশ্নঃ আপনি নাকি কোনওদিনই স্কুলে যাননি!
লতাঃ না, একবার গিয়েছিলাম। তার আগে বাড়িতে লিখতে শিখেছিলাম। স্কুলে গেলাম। স্যার লিখতে দিলেন। আমি লিখলাম। উনি খুব খুশি হলেন। তারপরে একদিন আশাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে গেলাম। আশা তখন খুবই ছোট। স্যার ধমক দিলেন, বললেন, ওকে কেন সঙ্গে এনেছো ? আমার খুব খারাপ লেগেছিল। তারপর থেকে আমি আর স্কুলে যাইনি। লেখাপড়া শেখাই আর হল না।
প্রশ্নঃ কখনও ইচ্ছে করেনি ?
লতাঃ ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলাম। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আমিই সবার বড়। পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ল আমার ঘাড়েই। আমার বয়স তখন মাত্র এগারো। নেমে পড়তে হল অভিনয়ে। স্টেশন থেকে স্টুডিও অনেকটা পথ। কিন্তু হেঁটেই যেতাম। পঞ্চাশ পয়সা বাঁচিয়ে বাড়ির জন্য সবজি কিনতাম। বিশ্বাস করুন, অভিনয় একেবারেই ভাল লাগত না। ইচ্ছে করত গান করতে। পরে অবশ্য প্লে ব্যাক করার সুযোগ এল।
প্রশ্নঃ আশার সঙ্গে কি তখন থেকেই বিচ্ছেদ ?
লতাঃ হ্যাঁ, এটা ঘটনা, দীর্ঘদিন আশার সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। ও খুব অল্প বয়সে একজনকে বিয়ে করে বাড়ি থেকে চলে যায়। ওর এভাবে চলে যাওয়াটা আমি বা বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারিনি। তবুও যোগাযোগ থাকত। কিন্তু আশার স্বামী চায়নি সে আমাদের সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ রাখুক। আমার সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছিল। পরে ওদের ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর আশাও আমাদের বাড়িতেই ফিরে এল। তারপর থেকে আর কোনও সমস্যা নেই।
প্রশ্নঃ তখন বেশিরভাগ ভাল গানই তো আপনি পেতেন। নায়িকার লিপ মানেই আপনি। আশা নাকি তেমন কাজ করার সুযোগ পাননি।
লতাঃ এটা একেবারেই ভুল ধারনা। ও তো সব ধরনের গানই গেযেছে। এতরকমের গান তো আমি গাইতাম না। ও পি নাইয়ারের কথাই ধরুন। উনি তো শুধু আশাকে দিয়েই রেকর্ড করাতেন। এসডি বর্মণের সুরেও আমি খুব বেশি গান গাওয়ার সুযোগ পাইনি। উনি তো আশাকে দিয়েই গাওয়াতেন। আর আশার মতো এমন ভার্সেটাইল সিঙ্গার এ দেশে আর কে আছে ? সবধরনের গানেই পারদর্শী। ও আমার ছায়ায় থাকবে কেন ? ওর গান আর আমার গান একেবারেই আলাদা। নিজের গানে ও একইরকম উজ্জ্বল।
শচীন দেববর্মণের সঙ্গে নাকি আপনার সেইসময় খুব ঝগড়া চলছিল?
লতাঃ ঝগড়া নয়, তবে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। প্রায় চোদ্দ বছর আমি তাঁর ছবিতে গান গাইনি। আসলে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নানারকম লোকজন আছে। তারা একেকজনের কানে একেকরকম মন্ত্র ঢালে। আমার কাছেও অনেকে অনেকরকম বলত। আমি কানে তুলতাম না। হয়ত উনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। বলা হযেছিল, আমি নাকি বর্মণদার সুরে গান গাইতে চাই না। পরে অবশ্য উনি নিজে থেকেই ফোন করেন। সম্পর্ক অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
প্রশ্নঃ মহম্মদ রফির সঙ্গেও তো দীর্ঘদিন গান গাননি। তাঁর সঙ্গে কী নিয়ে বিতর্ক ?
লতাঃ হ্যাঁ, এটাও সত্যি ঘটনা। তবে ঘটনাটা সামান্যই। আমাদের মধ্যে রয়্যালটি নিয়ে একটা বিতর্ক হয়েছিল। বয়স হয়ে গেলে অনেক শিল্পীই অসহায় হয়ে পড়েন। তাঁদের উপার্জন বলে কিছু থাকে না। আমরা চেয়েছিলাম, শিল্পীরাও যেন গানের রয়্যালটি পান। রফি সাহেব বলেছিলেন, গান গেয়ে এককালীন যা পাই, এর বেশি কিছু চাওয়া ঠিক নয়। আমাদের যুক্তি ছিল, ক্যাসেট কোম্পানি যদি পায়, প্রোডিউসার যদি পায়, তাহলে শিল্পীরা বঞ্চিত থাকবে কেন? বিশেষ করে যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, তাদের অন্তত দেওয়া হোক। একটা সুস্থ বিতর্ক। উনি হঠাৎ করে রেগে গেলেন। আমাকে ‘মহারানী’ বলে কটাক্ষ করলেন । তারপর সবার সামনে চেঁচিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আর কোনওদিন গান গাইবেন না। বিষয়টা আমারও ভাল লাগেনি। আমিও বলে ফেলেছিলাম, আপনার সঙ্গে আমিও আর গাইব না। তারপর তিন বছর এই বিচ্ছেদ চলেছিল। কেউ কারও সঙ্গে ডুয়েট গাইনি। পরে শঙ্কর-জয়কিশেনের মধ্যস্থতায় মিটমাট হয়। ওঁরা বললেন, আমরা দুজন একসঙ্গে না গাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রির অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাল গান হারিয়ে যাচ্ছে। তখন ফের একসঙ্গে গাইতে শুরু করলাম।
প্রশ্নঃ আপনি পাকিস্তানেও এত জনপ্রিয়। ওরা নাকি বলত, লতাকে দিয়ে দিন, কাশ্মীর নিয়ে নিন।
লতাঃ হ্যাঁ, কেউ কেউ এমন বলত। আমার কানেও এসেছিল। ওগুলো নিছক মজা। তবে পাকিস্তানেও সঙ্গীতের একটা আলাদা ঘরানা আছে। মেহেদি হাসান, গুলাম আলি তো ছিলেনই। আমার প্রিয় গায়িকা নুরজাহানও পাকিস্তানে চলে যান। পরেরদিকে এলেন নুসরত ফতে আলি খান। ওদের সবার গান আমি শুনতাম। অনেককিছু শেখার চেষ্টা করতাম। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার কখনও পাকিস্তানে যাওয়া হয়নি। দুবার যাওয়ার কথা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি। খুব আক্ষেপ থেকে গেছে।
প্রশ্নঃ গজলের দুনিয়ায় আপনাকে সেভাবে দেখা গেল না কেন?
লতাঃ আমি তো গজল গেয়েছি। তবে আরও গাওয়া উচিত ছিল। মেহেদি হাসান বা গুলাম আলির গান যখন শুনি, মুগ্ধ হয়ে যাই। আমাদের দেশের জগজিৎ সিংয়ের কথাই দরুন। কী উদাত্ত গলা! ওদের মতো যদি গাইতে পারতাম! আসলে এখন গান কম হয়, বাজনাই বেশি। আগে সিঙ্গারদের একটু রেস্ট দিতে বাজনা হত। এখন উল্টোটা। যারা বাজায়, তাদের রেস্ট দিতে এখন গাইতে হয়। দিনদিন গানবাজনার পরিবেশটাই কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মেলোডি নেই। এর জন্য আমি অবশ্য শ্রোতাদেরও কিছুটা দায়ী করতে চাই। তাঁরা এসব গান শুনছেন বলেই গাওয়া হচ্ছে।
প্রশ্নঃ আশা যে ধরনের গান গেয়ে থাকেন, আপনি কেন চেষ্টা করেননি ? এটা কি আপনার সীমাবদ্ধতা নয় ?
লতাঃ জানি না। হবে হয়তো। আসলে, সব ধরনের গান আমার ভালোও লাগে না। আমি যেটুকু পারি, সেটুকুই করার চেষ্টা করি। গান বাছার ক্ষেত্রে আমি খুব খুঁতখুঁতে ছিলাম। পছন্দ হলে তবেই গাইতাম। যে যা গাইতে বলল, গেয়ে ফেললাম, এমনটা কখনই করিনি। পরের দিকে সুরকাররাও জেনে গেলেন, আমি কী ধরনের গান পছন্দ করি।
প্রশ্নঃ এখন যখন নিজের গান নিজে শোনেন, তখন কী মনে হয় ?
লতাঃ একটা সত্যি কথা বলব ? বিশ্বাস করবেন ? আমি নিজের গান একেবারেই শুনি না। শুনলেই মন খারাপ হয়ে যাবে। মনে হবে, এটা এভাবে না করে অন্যভাবে করলে ভাল হত। মনে হবে, এই সুরটা অন্যরকম হতে পারত। সাতের দশকে যা ভাল লেগেছিল, এত বছর পর তা ভাল নাও লাগতে পারে। তাই নিজের গান থেকে আমি দূরে দূরেই থাকি।
প্রশ্নঃ পরেরদিকে আপনি আর ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড নিতেন না। এটা কেন ?
লতাঃ আমি তো অনেকবারই পেয়েছি। মনে হল, এবার নতুনদেরও পাওয়া উচিত। একটা পুরস্কারের মূল্য অনেক। একটা পুরস্কার পেলে সুরকাররা সেই শিল্পীকে সুযোগ দেন। আবার সুরকার পুরস্কার পেলে পরিচালকরা তাঁকে নেন। তাদের কাছে এই পুরস্কারের গুরুত্ব আছে। আমাকে এত বছর পর নিশ্চয় পুরস্কার দিয়ে নিজেকে চেনাতে হবে না। ওটা নতুনরা পেলেই ভাল। তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
প্রশ্নঃ এত সাফল্য। তবু এত নিঃসঙ্গ। কখনও একা লাগে না ?
লতাঃ যা হওয়ার, তাই হয়। সবকিছুই বোধ হয় আগে থেকে নির্ধারিত থাকে। ছোটবেলা থেকে গানকেই ভালবেসে এসেছি। একাকীত্বই আমার গানের প্রতি অনুরাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া, সে অর্থে আমি একা কোথায় ? ভাই বোনরা তো আছে। তাদের সঙ্গে আড্ডা মারি, গল্প করি। বিয়ে না করার জন্য আমার মনে কোনও অনুশোচনা নেই। হলেই হয়ত অনেককিছু তালগোল পাকিয়ে যেত। কী জানি, হয়ত দু বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যেত। তখন সেই দুঃখ বয়ে বেড়াতে হত। তার চেয়ে এই বরং ভাল আছি।