বেঙ্গল টাইমস প্রতিবেদন: বিধানসভায় ফের ঝড় তুললেন আলি ইমরান (ভিক্টর)। কাটমানি নিয়ে গোটা বাংলা যখন উত্তাল, তখন এই ইস্যুতে সরকারের ওপর আরও চাপ বাড়ালেন তরুণ বাম বিধায়ক। রাজ্যপালের ভাষণের ওপর বিতর্কে রাজ্যের বিভিন্ন সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে কোণঠাসা করলেন শাসকদলকে। শুধু নিচুতলায় নয়, উঁচুতলায় কীভাবে কাটমানি প্রভাব বিস্তার করেছে, একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে বাজিমাত করলেন বিধানসভায়। সভার ভেতর ও বাইরে বলা তাঁর বক্তৃতার নির্যাস—
১) সরকার বলছে, সবুজ সাথী প্রকল্পে এক কোটি সাইকেল দেওয়া হয়েছে। তার মানে, জেলা পিছু পাঁচ লাখ। একটা জেলায় পাঁচ লাখ সাইকেল দেওয়া হলে, সেই জেলায় তো সাইকেলের কারখানা হতে পারত। রাজ্যে অন্তত কুড়িটি সাইকেল কারখানা হতে পারত। তাহলে, নামী দামী কোম্পানিগুলো সাইকেল কারখানা করল না কেন? এই সাইকেল সরকার কিনছে থার্ড পার্টির কাছ থেকে। টেন্ডার করে সরাসরি সেই কোম্পানির কাছেই কিনতে পারত। যে সাইকেল পাইকারি হারে দেড় হাজার টাকায় পাওয়া যেত, সেই সাইকেল কেনা হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি টাকায়। অর্থাৎ, সাইকেল পিছু দু হাজার টাকার কাটমানি। এক কোটি সাইকেল মানে, দু হাজার কোটি।
২) গোটা রাজ্য নীল সাদা রঙে মুড়ে ফেলা হয়েছে। সেই রঙ কোথা থেকে কেনা হচ্ছে? সেই কোম্পানির নাম সবাই জানেন। সেই কোম্পানির মালিক কার স্নেহধন্য, সেকথাও সবাই জানেন। বেশ কয়েক হাজার কোটির কাজমানি। সরকারের সাহস হবে তদন্ত করার?
৩) মুখ্যমন্ত্রী দেড়শোর বেশি প্রশাসনিক সভা করেছেন। কারা প্যান্ডেল করে? কোচবিহারের সভা হলেও প্যান্ডেলের বরাত পায় টালিগঞ্জের মডার্ন ডেকরেটার্স। পুরুলিয়ায় সভা হলেও তারাই প্যান্ডেল করে। কোচবিহার বা পুরুলিয়ায় কি প্যান্ডেল করার কেউ নেই? পুরুলিয়ার কোনও ডেকরেটার বরাত পেলে ভাবতাম, পুরুলিয়ার কোনও নেতা হয়ত কাটমানি পেয়েছেন। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার ডেকরেটার বরাত পেলে, সেই কাটমানি কোথায় যাওয়ার কথা?
৪) সরকারি হোর্ডিং ও বিজ্ঞাপন। এই বাবদ এই সরকারের ব্যয় এক লক্ষ কোটি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আগেও সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হত কিন্তু সরকার সরাসরি কাগজকে দিত। এখন সেটাও হচ্ছে এজেন্সির মাধ্যমে। কোন এজেন্সি এই বরাত পাচ্ছে? সেই জেনেসিস অ্যাডভার্টাইজিং কারা চালায়? বকলমে কারা চালায়? কত কোটির বরাত তাদের দেওয়া হয়েছে? সরকারের সৎসাহস থাকলে বিধানসভায় সেই তথ্য তুলে ধরুন।
৫) এগুলি হল সরকারি কাটমানি। এর বাইরে মারাত্মক তিনটি বেসরকারি কাটমানি আছে। বালি, কয়লা ও গরু পাচার। এই পাচারের পেছনে হাজার হাজার কোটির লেনদেন। কার কাছে যায়, গোটা রাজ্য জানে। শুধু আমাদের পুলিশমন্ত্রী জানেন না। যসব এলাকা দিয়ে এইসব পাচার হয়, সেইসব এলাকায় ভোটের ফলাফল লক্ষ করুন। শাসকদলের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। অর্থাৎ, ডিএম–এসপিরা চোখ বন্ধ করে থাকলেও মানুষ উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিয়েছে।
৬) মনে রাখবেন, হাজার জাহার কোটির এই কাটমানি কিন্তু জেলার নেতারা পাননি। একেবারে কেন্দ্রীয় স্তরেই এসেছে। কারণ, বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো বড় বড় ‘অনুপ্রেরণা’ ছাড়া সম্ভব হয় না। জেলায় পঞ্চায়েত প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির মেম্বারদের ঘেরাও হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বার্তা দিচ্ছেন, কাটমানি ফেরত দাও। আসল জায়গায় হাত দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। সেখানে তিনি সত্যিই বড় অসহায়।
৭) বাম ভোট কেন বিজেপিতে গেল, তা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাঁদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, বামেদের ভরসাতেই যেন তাঁরা ভোটে লড়েছেন। তৃণমূলকে জেতানোর দায়িত্ব যেন বামেরা নিয়ে রেখেছিল। বিজেপির বাড়বাড়ন্ত কার জন্য? দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যদি বিজেপি হয়, তবে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক শক্তি অবশ্যই তৃণমূল। নিজের সুবিধার জন্য ধর্মের ভিত্তিতে ভোট বিভাজন করতে চেয়েছেন। এখন তারই মাশুল দিচ্ছেন। আমি একজন মুসলিম হয়েও বলছি, আপনার কোনও করুণা চাই না। দয়া করে মুসলিমদের তোষণ করবেন না। পারলে তাঁদের শিক্ষা দিন, চাকরি দিন, চিকিৎসা দিন। তার বদলে আপনি কিছু ইমামকে ধরে ফেলছেন। কিছু অপরাধীকে আড়াল করছেন। এতে দুই সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে ফাটল ধরছে। মুসলিমদের সম্পর্কে হিন্দুদের মনে খারাপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। আপনি যত তোল্লাই দেবেন, হিন্দু ভোট তত বিজেপির দিকে যাবে। পরে সেই দোষ বামেদের ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হবে না।
৮) দিনের পর দিন বিরোধী শিবিরে ভাঙন ধরিয়েছেন। ২১০ আসন পাওয়ার পরেও বাম থেকে, কংগ্রেস থেকে এমএলএ, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত মেম্বারদের ভাঙিয়েছেন। এখন আপনার দলে সেই ভাঙন শুরু হয়েছে। রোজ কেউ না কেউ চলে যাচ্ছে। এখন যতই গদ্দার বলুন, নিজের দলের লোকেরাই হাসবে। পঞ্চায়েত ভোট গায়ের জোরে জিততে গেছেন। সেইসব এলাকায় চূড়ান্ত ভরাডুবি হয়েছে। এরপরেও অতীত থেকে কোনও শিক্ষা নেননি। দিনের পর দিন বিধানসভায় আমরা ভুল ধরিয়ে দিয়েছি। আপনি শোনেননি। তাই এখন প্রশান্ত কিশোরকে ভাড়া করে আনতে হচ্ছে। কয়েকশো কোটি খরচ করে তাঁর কাছে বুদ্ধি কিনতে হচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও বিপর্যয় এড়াতে পারবেন না। এই সরকারের পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা।