সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
সম্প্রতি দেশে দুটি সাম্প্রদায়িক ঘটনা শিরোনামে এসেছে। প্রথমটি ঝাড়খণ্ডে। সেখানে এক মুসলমান যুবক তাবরেজ আনসারিকে মোটরসাইকেল চুরির অপবাদ দিয়ে কিছু ক্রোধোন্মত্ত জনতা শারীরিকভাবে চূড়ান্ত নিগ্রহ করেছে। এবং সে “বিধর্মী” বলেই হয়তো জোর করে তাকে “জ়য় শ্রী রাম” বা “জয় হনুমান” বলতে বাধ্য করা হয়েছে। নিগ্রহের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, সাঙ্ঘাতিকভাবে জখম হওয়া ওই হতভাগ্য যুবক হাসপাতালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে খাস কোলকাতার বুকেই। এক মাদ্রাসা শিক্ষক “জয় শ্রী রাম” বলতে অস্বীকার করায় তাঁকে বালিগঞ্জ স্টেশনে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া দেয় ওই ট্রেনে থাকা একটি উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের কিছু লোক। সংবাদমাধ্যমে পাওয়া খবর অনুযায়ী, তিনি সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়েছেন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত বেশ তীব্র।
বস্তুতঃ এই দুটি ঘটনা থেকে একটাই জিনিস স্পষ্ট, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জনাদেশ পেয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রকারান্তরেই দেশের বিভিন্নস্থানে ধর্মের নামে এই বর্বরতাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা। বিগত পাঁচ বছরে আমরা দেখেছিলাম, রামের নামে এক শ্রেণীর উগ্র ধর্মান্ধদের শক্তির আস্ফালন এবং পৈশাচিক উল্লাস। কোথাও ঈদের সময়ে ঘরফেরত জুনেইদকে ট্রেনের মধ্যেই শারীরিক নিগ্রহ করে হত্যা করা হয়েছিল। কোথাও বা শুধু গোমাংস রাখার মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আখলাখকে খুন করেছিল “গোরক্ষা বাহিনী” নামে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কিছু লোক। সারা দেশ শিউরে উঠেছিল রাজস্থানে আফরাজুল নামে মালদহের এক শ্রমিককে নৃশংসভাবে প্রহার ও জীবন্ত দগ্ধ করার দৃশ্য দেখে। সেই মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির নেপথ্যে ছিল শম্ভুলাল রেগার নামে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী। এইরকম অজস্র ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে। সংখ্যালঘু ও দলিতের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ, শারীরিকভাবে হেনস্থা, মহিলাদের ধর্ষণ করার মতো ঘটনা বারবার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই সব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরা শাসক দল ও তার সরকারের আনুকূল্যে সময়মতো “বিনা অপরাধে” বেকসুর খালাস পেয়েও গেছে।
রামের নামের এই আগ্রাসন অবশ্য সারা দেশে নতুন কিছু নয়। পুরাণ মতে যে “রামনাম” উচ্চারণ করে দস্যু রত্নাকর হয়ে গেছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি, যে “রাম নাম” নাথুরামের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মহাত্মা গান্ধীর মুখেও শোনা গিয়েছিল জীবনের অন্তিম লগ্নে, সেই “রামনামেই” সারা দেশে আজ চলছে হিন্দুত্ববাদের সীমাহীন অত্যাচার এবং নারকীয় সন্ত্রাস। আমরা দেখেছিলাম ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছিল আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ,বজরং দল ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। পুরো ঘটনার নেপথ্যে যোগসাজশ ছিল বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলি মনোহর যোশি প্রমুখের। সেই দিন থেকেই বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু অযোধ্যায় ‘রামমন্দির’ নির্মাণ। দেশবাসী ২০০২ সালে প্রত্যক্ষ করেছিল গুজরাটে সংঘটিত হওয়া ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেখানেও অন্তঃসত্তা এক সংখ্যালঘু মহিলার যোনি বিদীর্ণ করে তাঁর গর্ভের সন্তানকে বাইরে বের করে এনে ত্রিশুলে গেঁথে “জ়য় শ্রী রাম” ধ্বনি তুলে পৈশাচিক উল্লাসে মেতেছিল কিছু গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা ধর্মান্ধ। সেদিনের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী আজ সারা দেশের প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, এই বছরের লোকসভা নির্বাচনে ফের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তিনি ফের প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং আগামীর দিন গুলোতে “রামনামের” এই নারকীয়তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। সর্বোপরি, বাংলাতেও তাঁর দলের অভাবনীয় সাফল্য। যে বাংলা এতদিন তার ঐতিহ্য,তার সংস্কৃতি,তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে এসেছে, সেই বাংলাতেই সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের শিকার হলেন এক শিক্ষক।
হিন্দু সংস্কৃতির আরাধ্য দেবতা রামের নামে হিন্দুত্ববাদের এই আগ্রাসনের শেষ কোথায় ? আমরা কি সত্যিই বুঝতে পারছি যে, আমরা ‘রামরাজ্যের’ নামে এক বধ্যভূমিতে বাস করছি ?