রক্তিম মিত্র
বছর সাতেক আগের ঘটনা। তখনও সারদা কান্ড কেলেঙ্কারি হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। তখনও সারদায় লালবাতি জ্বলেনি। তখনও সুদীপ্ত সেন বহাল তবিয়তেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেইসময় বিধানসভায় বাম বিধায়করা দাবি তুলেছিলেন, রাজ্য জুড়ে চিটফান্ডের রমরমা। মানুষকে প্রতারিত করা হচ্ছে। সরকার অবিলম্বে ব্যবস্থা নিক। বিধানসভায় চিটফান্ড নিয়ে আলোচনা হোক।
ব্যাস, তেড়ে এলেন তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীরা। এ যেন ‘ঠাকুর ঘরে কে, আমি কলা খাইনি।’ প্রথমে নিজেদের আসনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে গেলেন। কাজ হল না। এবার বিরোধীদের আসনের কাছাকাছি এসে মারধর শুরু করলেন। আক্রান্ত হলেন গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। চুলের মুঠি ধরে চড় মারা হল দেবলীনা হেমব্রমকে। যাঁরা মারলেন, তাঁরা পাড়ার মস্তান নন। তাঁরা সবাই তৃণমূলের বিধায়ক। কেউ কেউ মন্ত্রী। গোটা ব্যাপারটাই ঘটল মুখ্যমন্ত্রী ও স্পিকারের চোখের সামনে। বিধানসভার ভিডিও ফুটেজ থাকার কথা। না থাকলে বুঝতে হবে সারদার অধিকাংশ প্রমাণের মতো এটাও লোপাট হয়েছে। গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, দেবলীনা হেমব্রমদের হাসপাতালে পাঠানো হল। কিন্তু এমনই ভয়ের আবহ, চিকিৎসকরা চিকিৎসাই করলেন না। থানাও অভিযোগ নিতে চাইল না।
পরের দিন বিধানসভায় দুরন্ত এক বক্তৃতা করেছিলেন তরুণ ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক আলি ইমরান (ভিক্টর)। স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, আপনার আর মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেবলীনা হেমব্রমকে চুলের মুঠি ধরে চড় মারা হয়েছে। আপনি চেয়ারে থেকেও কিচ্ছু করতে পারেননি। পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি। যদি চেয়ারের মর্যাদা রাখতে চান, এখনও সময় আছে, ভিডিও ফুটেজ দেখুন। চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিন। মনে রাখবেন, ওই চড়টা দেবলীনা হেমব্রমের গালে নয়, আপনার গালে মারা হয়েছে। যে মুখ্যমন্ত্রী নিজের চোখের সামনে সভার এক মহিলা বিধায়ককে চড় খেতে দেখলেন, চড়টা আসলে তাঁর গালেই মারা হল।
বাংলা কাগজগুলি ভিক্টরের এই বক্তব্য ছাপার সাহস দেখায়নি। কিন্তু বেশ কয়েকটি ইংরাজি ও হিন্দি কাগজে ভিক্টরের এই বক্তব্য ছাপা হয়েছিল।
সাত বছর পর গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় সেই পুরনো ঘটনা মনে পড়ে গেল। একই দিনে আক্রান্ত হলেন আসানসোলের বাম প্রার্থী গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি ও ডায়মন্ড হারবারের প্রার্থী ফুয়াদ হালিম। কারা এই আক্রমণের সঙ্গে যুক্ত, একটু চেষ্টা করলেই জানা যায়। কারা এর পেছনে, সেটা বুঝতেও কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পুলিশ হয়ত নাম কে ওয়াস্তে দু একজনকে ধরবে। লঘু ধারা দেওয়া হবে। জামিন পেতে কোনও সমস্যা হবে না।
মুশকিল হল, একই দিনে দু’দুজন লোকসভার প্রার্থী আক্রান্ত হলেন। অথচ, কোনও মহলেই কোনও লজ্জা নেই। নির্লজ্জের মতো কোনও মন্ত্রী বলছেন, এটা ওদের দলীয় কোন্দল। কেউ বলছেন, এটা নাটক। এমন ঘটনার পরেও বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠে ধিক্কার নেই। ঘৃণা নেই। মিডিয়াতেও নিছক একটা মামুলি আইটেম। ভাবুন তো, বাম জমানায় যদি তৃণমূলের দুজন প্রার্থী এভাবে আক্রান্ত হতেন, কী তুলকালামটাই না ঘটে যেত! নিন্দার বন্যা বয়ে এত। সাতদিন ধরে সেইসব ফুটেজ দেখানো হত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, জ্যোতি বসুদের কুশপুতুল পোড়ানো হয়ে যেত।
আসলে, রোজ এত ঘটনা ঘটছে, সবকিছুকেই এখন মামুলি মনে হয়। মন্ত্রীরাও নির্লজ্জ মিথ্যে বলতে পারেন। যে যাকে খুশি, হুমকি দিতে পারে। কোথাও কোনও নিয়ম মানার দায় নেই। মিডিয়াও বেমালুম চেপে যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন থেকে আদালত, তারাও হয়ে ওঠে যাবতীয় গুন্ডামির দার্শনিক প্রশ্রয়দাতা।
আবার ভিক্টরের সেই ভাষণের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেদিন বিধানসভায় একেবারে সঠিক জায়গাতেই আলো ফেলেছিলেন ভিক্টর। সাফ জানিয়েছিলেন, এই দেবলীনা হেমব্রমকে নয়। এই থাপ্পড় মারা হল স্পিকারকে। দুই প্রার্থী আক্রান্ত হওয়ার পরও সেটাই বলতে ইচ্ছে করছে। আপাতভাবে মনে হচ্ছে, গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি বা ফুয়াদ হালিমকে মারা হল। আসলে, এই থাপ্পড় মারা হল পুলিশ সুপারকে। এরপরেও রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকের বিন্দুমাত্র লজ্জা হয় না। এরপরও গলা চড়িয়ে ভাষণ দিয়ে চলেছেন। এই থাপ্পড় হয়ত পিসিমণির গালেও। লুম্পেন বাহিনী কারও কোনও বাধাই মানছে না। চাইলেও এঁদের আর আটকানো যাবে না। সেদিন আর দূরে নেই, যেদিন এই লুম্পেন বাহিনীর হাতে কোনও ভাই, কোনও ভাইপোই হয়ত নিরাপদ থাকবে না।