সাত দফা, আসলে সাত থাপ্পড়

রক্তিম মিত্র

গোটা দেশে সাত দফায় ভোট। এই বাংলাতেও। ৪২ টি আসনে সাত দফা দরকার হচ্ছে কেন?‌ এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু সেই প্রশ্ন যত না নির্বাচন কমিশনের কাছে, তার থেকে বেশি রাজ্য প্রশাসনের কাছে। রাজ্যে নির্বাচন এতটাই ‘‌অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’‌ হয় যে, সাত দফা ছাড়া উপায় খুঁজে পেল না নির্বাচন কমিশন।
মাত্র এক বছর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে কী কী ঘটেছিল, তা হয়ত অনেকেই ভুলে গেছে। ৩৪ শতাংশ আসনে বিরোধীরা মনোনয়নই দিতে পারেননি। যেসব আসনে মনোনয়ন দেওয়া গেছে, সেইসব আসনেও কুড়ি শতাংশ ভোটার ভোট দিতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। কোথাও সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি, রাতেই ভোট চুকে গেছে। কোথাও আবার বেলা দশটার মধ্যেই ঝাঁপ বন্ধ। সারাদিন ধরে অবাধে চলেছে ছাপ্পার উন্নয়ন। গণনাতেও রেহাই নেই। সেখানেও চলছে দেদার ছাপ্পা। এরপরেও যাঁরা জিতলেন, তাঁদের ভয় দেখিয়ে, লোব দেখিয়ে শাসক দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হল। তারপরেও যাদের ভাঙানো গেল না, সেসব এলাকায় দিনের পর দিন নানা টালবাহানায় বোর্ডগঠনই করতে দেওয়া হল না। না, এগুলো কোনওটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পুলিশের বড়কর্তারা জানেন। সরকারের নেতা–‌মন্ত্রীরা জানেন। যাঁর ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ ছাড়া কোনওকিছুই হয় না, তিনিও জানেন।

vote6
টিভিতে যেটুকু উঠে এসেছে, তা নেহাতই সামান্য। হিমশৈলের চূড়ামাত্র। গ্রামে গ্রামে গিয়ে ওই ছবি তুলতে গেলে কী পরিণতি হতে পারে, জেলার সাংবাদিকরা ভাল করেই জানেন। আর কাগজগুলির কী দশা, তা তো প্রতিদিনই বুঝতে পারছি। উন্নয়নের স্রোতে গা না ভাসালে ধোপা নাপিত বন্ধ। ফলে, শহরের ড্রয়িংরুমে বসে গ্রামের আসল চিত্রটা বোঝা আসলে স্বপন সাহার ছবি দেখে হলিউডের বিবর্তন বোঝার মতোই। সারা রাজ্যে কুড়ি শতাংশ মানুষও ভোট দিতে পারেননি। গোটা দেশে এই ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই বাংলা শীর্ষে। ধারে কাছে দ্বিতীয়–‌তৃতীয় কাউকে পাওয়াও যাবে না।
বিরোধীরা সমালোচনা করবে, সেটা স্বাভাবিক। তাঁরা নিরাপত্তার দাবি জানাবে, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের ভূমিকা এত নক্কারজনক হবে কেন? পঞ্চায়েত পর্বে‌ পুলিশ বলে বস্তুটির ওপর কি ভরসা রাখার কোনও উপায় ছিল?‌ জেলাশাসক থেকে পুলিশ সুপার সবার ভূমিকাই ছিল একেবারেই চাপরাশির মতো। প্রিন্ট মিডিয়া কার্যত ছিল জড়ভরত হয়ে। গোটা রাজ্যের একটা ব্লকের নাম বলতে পারেন যেখানে লাঠিসোঁটা হাতে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকেনি?‌ ব্লক অফিস তো ছেড়ে দিন, মহকুমা শাসকের অফিস চত্বরেও ডান্ডা হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছে উন্নয়নের কান্ডারিরা।

vote3
কোথাও কোথাও অশান্তি, সন্ত্রাস আগেও হয়েছে। তাই বলে গোটা রাজ্যব্যাপী এই চেহারা?‌ দেশের কোথাও এই নজির নেই। এমনকী কাশ্মীরের ভোটও সম্ভবত এর থেকে শান্তিতে হয়। বাংলার মূলস্রোত মিডিয়া ভয়ে চুপ থাকতেই পারে, কিন্তু এ রাজ্যে ভোটের আসল চিত্রটা এখন আর গোপন নেই। তারই প্রতিফলন নির্বাচন কমিশনের এই সাত দফার বিন্যাসে। শুধু সাত দফা নয়, এটা আসলে মোক্ষম সাত থাপ্পড়। কিন্তু রাজ্য সরকার বা শাসক দল কি আত্মসমীক্ষা করবে?‌ সম্ভাবনা কম। এসব তাদের অভিধানে নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.