রক্তিম মিত্র
প্রথা ভেঙে অনেকটাই বেরিয়ে এল সিপিএম। তুলনায় সেই পিছিয়েই রইলেন শরিকরা। ফলে, একদিকে যখন মঞ্চ মাতিয়ে গেলেন দেবলীনা হেমব্রম, তখন বিরক্তি বাড়িয়ে গেলেন শরিক দলের নেতৃত্ব।
তিন শরিকের বক্তা তালিকায় কোনও চমক ছিলন না। বললেন তিন দলের তিন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। শুরু হল ফরওয়ার্ড ব্লকের দেবব্রত বিশ্বাসকে দিয়ে। মাঝে সিপিআইয়ের সুধাকর রেড্ডি। তারপর আরএসপির ক্ষিতি গোস্বামী। ক্ষিতিবাবুকে মোটামুটি পাসমার্ক দেওয়া যায়। বাকি দুজন ডাঁহা ফেল। পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এমন জনসভায় ভাষণ দেওয়ার মতো বক্তা তাঁরা নন। না হতেই পারেন। কিন্তু তাঁদের বক্তৃতা যে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষের মধ্যে কোনও রেখাপাত করছে না, এটুকু বোঝার মতো পরিণতি বোধটাও নেই। সেই বাঁধা গতের ভাষণ। নেহাত শুরুতে এঁদের দেওয়া হয়েছে। তাই তখনও বিরক্তি তেমন শুরু হয়নি। যদি মাঝামাঝি বা শেষদিকে দেওয়া হত, মানুষের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যেত। মাঝপথেই অনেকে পালিয়ে যেতেন।
কানহাইয়া কুমারকে আমন্ত্রণ জানানো হল। আপত্তি এল কিনা সিপিআই থেকে! তাঁদের দাবি ছিল, সুধাকর রেড্ডি বলবেন। বাধ্য হয়ে সিপিএম নেতৃত্ব মেনে নিলেন, বেশ দুজনেই বলবেন। সুধাকর রেড্ডি সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হতেই পারেন। কিন্তু এই সমাবেশে দূর দূরান্ত থেকে আসা শ্রোতাদের কাছে তাঁর বক্তৃতা শুধু বিরক্তি বাড়ানো ছাড়া আর কোনও বার্তাই বয়ে আনবে না, এটা ওঁরা বুঝতেও পারলেন না! অন্যদিকে দেবব্রত বিশ্বাস। দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু হলফ করে বলা যায়, তাঁর দলের পক্ষ থেকে যদি আলি ইমরান (ভিক্টর) বলতেন, ব্রিগেড সমাবেশ অন্য মাত্রা পেত। গোটা বাংলায় আজ ভিক্টরের নামে চর্চা শুরু হয়ে যেত। এতে ফরওয়ার্ড ব্লকের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হত। আরএসপি–র ক্ষেত্রে তেমন পরিচিত বা তুখোড় বাগ্মী যুব নেতা নেই। যাঁরা আছেন, তাঁদের তুলনায় এখনও ক্ষিতিবাবুর বক্তব্যের ধার অনেক বেশি। তাই সেক্ষেত্রে, অন্য কেউ বলতে গেলে হয়ত হীতে বিপরীত হতে পারত।
অন্যদিকে, সিপিএমকে দেখুন। মূলত দুটো বড় চমক দেখা গেছে। আর এই দুটোই কাজে লেগেছে। দুটো ক্ষেত্রেই প্রথা ভাঙতে হয়েছে। প্রথমত দেবলীনা হেমব্রম। নিঃসন্দেহে সাহসী সিদ্ধান্ত। এর আগে কখনও বৃন্দা কারাত, কখনও শ্যামলী গুপ্ত, রেখা গোস্বামীরা ভাষণ দিয়েছেন। এবার দেবলীনা যেভাবে ছাপ ফেললেন, এর আগে কোনও নেত্রীকে এই ভূমিকায় দেখা যায়নি। বাঁধা গতের ভাষণ নয়। একেবারে মেঠো ভাষায় জ্বালাময়ী ভাষণ। মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নেত্রী। জানেন, দর্শকরা গোল গোল তাত্ত্বিক কথা শুনতে আসেননি। দূরদূরান্ত থেকে আসা লড়াকু কর্মীদের কাছে যেমন বার্তা দেওয়া দরকার, ঠিক তেমনটাই দিয়েছেন। কখনও সাঁতালি, কখনও মেঠো বাংলা। কোনও সন্দেহ নেই, এই সমাবেশের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ তিনিই।
শেষ বক্তা কে হবেন? আগে শেষে বলতেন জ্যোতি বসু। পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আগের ব্রিগেডে শেষ বক্তা ছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। দলীয় প্রোটোকল মানলে এবারও রাজ্য সম্পাদক হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্রর বা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সীতারাম ইয়েচুরির শেষ ভাষণ দেওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা সেই জায়গাটা আঁকড়ে থাকেননি। পরিস্থিতির দাবিতে শেষে রেখেছেন মহম্মদ সেলিমকে। তাঁরা জানতেন, শেষদিকে সেলিমের ভাষণই ঘরমুখী মানুষকে মাঠে বসিয়ে রাখতে পারে। তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণই হতে পারে উপযুক্ত শেষ বার্তা। সেলিম সেই আস্থার মর্যাদা রাখতে পেরেছেন।
হ্যাঁ, এখানেই গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রথা ভেঙেছে সিপিএম। সময়ের দাবি মেনে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। আর ঠিক এখানেই পিছিয়ে রইল শরিকরা।