শ্রীজাত, এই বাংলাতেও আপনার বাক স্বাধীনতা নেই

শিলচরে কবিকে হেনস্থা করা হল। উদ্বেগ্ন মুখ্যমন্ত্রী ফোন করলেন, খোঁজ নিলেন। শ্রীজাত ধন্যবাদ জানাতেই পারেন। কিন্তু বলে বসলেন, এই বাংলায় বাক স্বাধীনতা আছে। এতবড় সার্টিফিকেট দেওয়াটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। একটু বেসুরো গাইলেই বুঝবেন, এই বাংলাতেও তাঁর বাক স্বাধীনতা নেই। লিখেছেন সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি।

গত সপ্তাহে বাংলার এইসময়ের জনপ্রিয় কবি শ্রীজাত অসমের শিলচরে একটি সাহিত্যগোষ্ঠীর আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। সেখানে নাকি সেই অনুষ্ঠানকে পণ্ড করার চেষ্টা করেছিল কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মীরা। শ্রীজাতকেও শারীরিক ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা হয়েছিল বলে সংবাদপত্রে বেরিয়েছে। যদিও পুলিশ ও উদ্যোক্তাদের তৎপরতায় শ্রীজাত নির্বিঘ্নেই সার্কিট হাউসে ফিরে আসেন। তবে তার আগে মঞ্চে উঠে সেই হিন্দুত্ববাদীদের একজন নাকি শ্রীজাতর হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে তাঁকে বক্তব্য রাখতে বাধা দেন বলে অভিযোগ। বাইরে থেকে লাগাতার তাঁরা শ্রীজাতের নামে “মুর্দাবাদ” স্লোগান দিয়েছেন। কবি যেখানে উঠেছিলেন, সেই সার্কিট হাউসের বাইরেও তাদের জমায়েত হয়েছিল। সার্কিট হাউস লক্ষ্য করে “ইঁটবৃষ্টি” চলছিল।
ঘটনাটা খুবই নিন্দনীয় এবং অনভিপ্রেত, সেই ব্যাপারে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। শ্রীজাত একজন কবি। বলা উচিত, এই সময়ের জনপ্রিয় একজন কবি। তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিরাপত্তা দিতে না পারা, সেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষতঃ যেখানে সেই অনুষ্ঠানের দু একদিন আগে থেকেই যখন শ্রীজাত প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন—এটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই হুমকি আসছিল সেই অনুষ্ঠান পণ্ড করার। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশি ও স্থানীয় কিছু মানুষের তৎপরতায় শ্রীজাতর কোনও ক্ষতি হয়নি। আর একজন কবির ওপরে এই ভাবে আঘাত হানা সুস্থ সমাজের পক্ষে নিতান্তই এক অশনি-সঙ্কেত।
কলকাতার ফিরে শ্রীজাত তাঁকে সর্বতোভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সেই উদ্যোক্তাদের যেমন ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তেমনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, স্থানীয় বিধায়ক এবং কলকাতার মেয়রকেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তাঁর ওপর আক্রমণের খবর পেয়েই একাধিকবার তাঁর কুশল জানার জন্য। সেইসঙ্গে দেখলাম তিনি এটাও জানিয়েছেন, “বাংলায় বাকস্বাধীনতা আছে। কিন্তু দেশের অন্যত্র সেরকম নয়। সেই অন্ধকারের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল”!

srijato2
এই বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলি, শ্রীজাত বাবু কি জানেন না, এই বাংলাতেই অম্বিকেশ মহাপাত্রের মতো একজন অধ্যাপককে সরকারের বিরুদ্ধে সামান্য কার্টুন প্রকাশ করে পুলিশি হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছিল ? তাঁকে একরাত কারারুদ্ধ হয়েও থাকতে হয়েছিল। আজও সেই অধ্যাপক সুবিচার পাননি। শ্রীজাতবাবু কি এটাও জানেন না যে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সভায় সামান্য প্রশ্ন করার অপরাধে শিলাদিত্য নামের এক যুবককে “মাওবাদী” তকমা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছিল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীরই নির্দেশে? বা গতবছরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ডেঙ্গু নিয়ে সরকারি হাসপাতালের লুকোছাপা নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় ডা:‌ অরুণাচল দত্ত চৌধুরিকে সাসপেণ্ড হতে হয়েছিল ? পঞ্চায়ের ভোটের প্রাক্কালে ‘‌রাস্তায় যখন উন্নয়ন দাঁড়িয়ে ছিল’‌, তখন একটি কবিতা লেখার ‘‌অপরাধে’‌ বর্ষীয়াণ কবি শঙ্খ ঘোষকে কীভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল!‌ এর বাইরেও ফেসবুকে সামান্য নিরীহ মন্তব্যের জন্য কত কত তরুণ–‌যুবককে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে, তার হদিশ নেই। কখনও পাড়ার দাদারা চমকাচ্ছে, তো কখনও পুলিশ ডেকে হুমকি দিচ্ছে।
শ্রীজাতবাবু তো “অরাজনৈতিক” নন। তাঁর সেই বিতর্কিত “অভিশাপ” কবিতায় বা সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ হত্যার পরে বা বাংলার বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক হিংসার পরে “আরশিনগর” কবিতায় তো তিনি ধর্মীয় এই মৌলবাদের এই রাজনীতির বিরুদ্ধে বারবারই সোচ্চার হয়েছিলেন !! সেই “প্রতিবাদী কবি” কি এই ঘটনাগুলো জানেন না? ‌
শ্রীজাতবাবু সবই জানেন। তিনিও জানেন, এই বাংলাতেও বাক স্বাধীনতা নেই। হয়ত তাই নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। অগ্রজ কবির বিরুদ্ধে কুরুচিকর আক্রমণের প্রতিবাদ তঁর লেখনীতে ধরা পড়েনি। সব ব্যাপারেই কি একজন কবিতে প্রতিবাদ জানিয়ে কবিতা লিখতেই হবে?‌ না এমন কোনও আজগুবি দাবি নেই। তবে সংবেদনশীল মানুষকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো নানা ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। যেগুলো কবিতার বিষয় হয়ে উঠতেই পারত। কিন্তু নাকি শাসকের প্রতি আনুগত্যের কারণেই তিনি “বাকস্বাধীনতা” হারিয়েছিলেন?

আসলে এই নীরবতার কারণটা ভয় নয়। কেন না যাঁর কলমে, ‘‌ওরাও মানুষ, আমরাও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়’‌ লেখা এসেছে, তাঁর কীসের ভয় ? দেশে বা বিদেশে কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার বা সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর শাসকদলের আঘাত বা আক্রমণ কোনও নতুন ঘটনা নয়। সারা বিশ্বেই এর দৃষ্টান্ত আছে। বাংলাতেও অতীতে ‘‌জরুরি অবস্থা’‌র সময় উৎপল দত্তের মতো লৌহমানব নাট্যপুরুষকেও কারাবরণ করতে হয়েছিল। যুগে যুগে সারা বিশ্বে বহু নাট্যকার, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিকরা কারারুদ্ধ হয়েছিলেন শাসক বা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলে বা কলম ধরে। এই ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ‘‌সহানুভূতি’‌ সবসময়ই সেই শিল্পী মানুষটির প্রতি বর্ষিত হয়। জনমানসে শাসকের এই ‘‌টুঁটি টিপে ধরার’‌ ঘৃণ্য মানসিকতার বিরুদ্ধে দাবানলের মতো ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তা অচিরেই অত্যাচারী, স্বৈরতান্ত্রিক সেই শাসকের পতনের পথ প্রশস্ত করে। ইতিহাসই তার সাক্ষ্য দেয়। তাহলে শ্রীজাতবাবুর ভয়টা কীসের ?

ভয় নয়, আসল উদ্দেশ্যটা মনে হয় আনুগত্য লাভ করা। কারণ, প্রায় সব কবিই জানেন, তাঁদের জীবনটা আসলে নদীর মতই। জোয়ার–‌ভাটা খেলে সবসময় সেখানে। যখন খ্যাতির শিখরে উন্নীত হন, তখন অজস্র পাঠক, বই বিক্রির আকাশছোঁয়া চাহিদা। কিন্তু যখন সেই “বাজার” অন্য কোনও নবাগত কবি বা লেখকের হস্তগত হয় তখন?‌ তখনই কবিদের জীবনে ভাঁটা নেমে আসে। তখন প্রয়োজন হ্য় সরকারি সুযোগ–‌সুবিধা ভোগের। শ্রীজাতবাবুর জনপ্রিয়তায় ভাটা এখন সেভাবে না পড়লেও হয়তো কিছু পাওয়ার আশায় বা হারানোর আশঙ্কায় কোথাও একটা আনুগত্য এসে যাচ্ছে।

শ্রীজাতবাবু, বাংলায় আপনারও কি আদৌ ‘‌বাকস্বাধীনতা’‌ আছে ? যিনি প্রকৃত প্রতিবাদী, তাঁকে কোনও একটি ধর্মের “পবিত্রতার প্রতীক” এ আঘাত হেনে নিজের প্রতিবাদী সত্তাকে প্রকাশ করতেও হয় না, আর সেই ধর্মের “উদগ্র দাসানুদাস” দের রোষানলে পড়ে নিজেকে বাঁচাতে “শিরদাঁড়ায় তফাৎ এনে” অন্য কারও বশ্যতাও স্বীকার করতে হয় না। সেই “প্রতিবাদীর” ক্ষুরধার কলম সমাজের যে কোনও অনাচারের বিরুদ্ধেই অগ্নি উদগার করে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.