‌ধর্মঘট যেমনই হোক, বোঝাপড়াটা অন্তত পরিষ্কার হল

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
জানুয়ারির ৮ এবং ৯ তারিখে ভারতবর্ষের বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলো ১২ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে যে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল, তার প্রভাব বাংলা–‌সহ সারা ভারতবর্ষেই কমবেশি অনুভব করা গিয়েছিল। সপ্তাহের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কর্মব্যস্ত দিনেও রাস্তাঘাট ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই ফাঁকা এবং বাসে-ট্রেনেও ভিড় অনেকটাই কম ছিল। এই ধর্মঘটে শুধু শ্রমিক সংগঠনগুলোই নয়, ব্যাঙ্ক এবং জীবনবীমা সংস্থা গুলোর কর্মচারীরাও সামিল হয়েছিলেন। ফলস্বরূপ ওই দুদিনই ভারতবর্ষের প্রায় সবকটি ব্যাঙ্কই ছিল বন্ধ। ধর্মঘটকারীরা এই ধর্মঘটের সাফল্য আদায়ের লক্ষ্যে বাংলার তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে একজোট হয়ে মিছিল থেকে শুরু করে রেললাইনে বসে পড়া বা রাস্তা আটকে যানচলাচলে বাধা সৃষ্টি যেমন করেছিল, তেমনি তাদের উচ্ছেদ করতে বাংলাতে শাসকদল পুলিশ এবং নিজেদের নেতা-কর্মীদের কাজে লাগিয়েছিল পুরোদমেই। তাতে ধর্মঘট সফল না বিফল সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, দিনের শেষে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একেবারে জলজ্যান্ত প্রমাণ পাওয়া গেল। হয়ত এটাই দুদিনের ধর্মঘটের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

bandh

কী প্রমাণ পাওয়া গেল? কেন্দ্রের শাসকদল আর বাংলার শাসকদলের মধ্যে যে “গোপন সখ্যতা” দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়া। নইলে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল কেন্দ্রের সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন তার বিরোধিতা করলেন? যিনি বিগত একবছর ধরে, প্রায় সবকটি রাজনৈতিক সভায় কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি–‌কে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে উৎখাত করার ডাক দিচ্ছেন, যাঁর মুখে স্লোগান শোনা যায়, “২০১৯, বিজেপি ফিনিশ”, যাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রোজেক্ট করে নাকি বামপন্থীরা ব্যতীত বিজেপি বিরোধী দেশের সবকটা রাজনৈতিক দল একত্রিত হওয়ার তোড়জোড় করছে বলে প্রচার চলছে গোটা বাংলা জুড়ে এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে, তিনি কেন বিজেপির বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘটকে ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন? কেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ ৮ এবং ৯ তারিখে প্রায় ২০০ বামপন্থী কর্মী, ছাত্র ও যুবদের মিথ্যে মামলায় গ্রেপ্তার করল? কেন পুলিশ প্রশাসন ধর্মঘটীদের উচ্ছেদ করতে লাঠিচার্জ থেকে জলকামান এমনকী টিয়ার গ্যাস ও ব্যবহার করল ?
এর অন্তর্নিহিত কারণটা এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। কেন্দ্র আর রাজ্যসরকারের যে “গোপন সমঝোতা” প্রায় প্রায় ৩ বছর ধরে চলে আসছে, তাকেই মান্যতা দেওয়া। তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ বামপন্থীরা ধর্মঘট ডাকলে, সেই ধর্মঘটকে বিফল করার সর্বতোভাবে চেষ্টা করা। বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর অতীতের এই কাহিনী যে কোন রাজনীতিমনস্ক মানুষের স্মৃতিতেই আজও অম্লান। ২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যিনি ছিলেন পুরোধা, সেই নরেন্দ্র মোদিই এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সেদিনের গুজরাটের সেই মুখ্যমন্ত্রী যখন গুজরাটের সেই ভয়ঙ্কর দাঙ্গার কারণে দেশে ও বিদেশে ধিকৃত হয়েছিলেন, তখন বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে “মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার শুভেচ্ছাস্বরূপ ফুলের তোড়া পাঠিয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তারই “প্রতিদান” হিসেবে সেদিনের গুজরাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বাংলার শাসকদল তৃণমূলের প্রতি বরাবরই নরম মনোভাবাপন্ন। “সারদা চিটফাণ্ড” কেলেঙ্কারিতে কয়েকলক্ষ মানুষ প্রতারিত, সর্বস্বান্ত হওয়ার পরেও, সেই আর্থিক কেলেঙ্কারিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত থাকা তৃণমুলের কোনও নেতা-মন্ত্রীই কেন্দ্রীয় সরকারের “বদান্যতায়” আজও শাস্তি পাননি। যে দু একজন বিধায়ক বা সাংসদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তারাও হয় কেন্দ্র সরকারের গোপন নির্দেশে বা সি.বি.আইয়ের ঔদাসীন্যে আজ কারাগারের বাইরে। প্রতারিত মানুষের চোখের জল, সর্বস্বান্তের হাহাকার—প্রধানমন্ত্রীকে স্পর্শ করে না, এদিকে তিনি “আচ্ছে দিন” আর “সবকা সাথ সবকা বিকাশ” এর গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন বিগত পাঁচ বছর ধরে দেশবাসীকে।
তিনি কেন্দ্রের গোয়েন্দাসংস্থা সি.বি.আই কে “শীতঘুমে” পাঠিয়ে দিয়েছেন। নারদ কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের প্রথমসারির নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী,সাংসদ রা কয়েকলাখ টাকা ঘুষ নিয়েও আজ কোনো এক “অজ্ঞাত কারণে” বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। কেন্দ্রের শাসকদল তথা বিজেপির এই “কোমলতার “প্রতিদান” হিসেবেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট ডাকলে তার বিরোধিতা করতে সচেষ্ট হন। তিনি নাকি “ধর্মঘটের বিরোধী”। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন যিনি ৭৩ বার ধর্মঘট ডেকেছিলেন, সিঙ্গুরের কারখানা স্থাপনের প্রতিবাদে যিনি টানা দুদিন ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন, তিনি আজ কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের প্রতিবাদকে স্তিমিত করার চেষ্টা করছেন, তাঁর নিজের ও তাঁর দলের কৃত অপরাধ থেকে বাঁচবার স্বার্থে !
এসব সত্ত্বেও বামপন্থীরা লড়াই করছে। ক্ষেতে, খামারে, কলে, কারখানায়, শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে বামপন্থীরা দিবারাত্র সচেষ্ট। রাজস্থানে কৃষকদের মাটিকাঁপানো সুদীর্ঘ পদযাত্রা দেখেছে গোটা দেশ। মহারাষ্ট্রেও একই ছবি দেখা গেছে। বাংলাতেও অনেক বঞ্চনা সয়ে সিঙ্গুরের চাষিরা জেগে উঠেছেন। বামপন্থীরা অতন্দ্র যাত্রী। শাসকের “দলদাস” পুলিশের লাঠি, গুলি, দমন পীড়ন সয়েও তারা লক্ষ্যে অবিচল। দুদিনের ধর্মঘটে ২০০ ছাত্র, যুব, প্রথসারির নেতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বাংলার শাসকদল সর্বতোভাবে ধর্মঘট প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। নিজের “লবণভুক্ত বীরপুঙ্গব” তথা “ভাড়াটে গুন্ডা” দের রাস্থায় নামিয়েছিল। এরপরেও কি ধর্মঘট “বিফল” একথা বলা যায় ? আর এই ধর্মঘটের ফলেই বাংলায় তৃণমূল আর কেন্দ্রের বিজেপির “গোপন বোঝাপড়া” জনসমক্ষে উদ্ভাসিত হয়েছে। বাংলার সাধারণ মানুষের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য এত বড় মাধ্যম আর কোথায়? এখানেই ধর্মঘটের আশাতীত সফলতা! এর পরেও কি মানুষের বিশ্বাস করা উচিৎ, যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দেশে বিজেপি বিরোধিতার “প্রধান মুখ” ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.