রক্তিম মিত্র
বড়দিনের আবহে যেন নতুন প্রাপ্তি। একশো টাকার কয়েন। সেই মুদ্রায় অটল বিহারী বাজপেয়ীর ছবি। অনেকে হয়ত আপত্তি তুলতে পারেন। বলতেই পারেন, ভোটের আগে বাজপেয়ীকে সামনে রেখে বিজেপির নতুন কৌশল।
সেই অভিযোগকে উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবু আমার কাছে বাজপেয়ীর নামে মুদ্রা খুব একটা আপত্তিকর মনে হচ্ছে না। তিনি এমনই এক মানুষ ছিলেন, যাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মুদ্রা তৈরি করাই যায়। তাছাড়া, সব সরকারই তাঁদের প্রিয় কিছু মানুষ স্মরণে কিছু না কিছু করে থাকে। কেউই এই অভিযোগ–মুক্ত নয়। তাই, বিজেপি সরকার যদি বাজেপেয়ীর নামে মুদ্রা করতে চায়, করতেই পারে।
আমার আপত্তি মুদ্রা নিয়ে নয়, মুদ্রা দোষ নিয়ে। কোন অনুষ্ঠানে কোন কথাটা বলতে হয়, আর কোন কথাটা বলতে নেই, এই ন্যূনতম শিক্ষাটুকু অনেকের থাকে না। বা থাকলেও ভুলে যান। এই রোগটি আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর যেমন আছে, তেমনই আছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও। দলীয় অনুষ্ঠানে তিনি যাঁকে খুশি আক্রমণ করতেই পারেন। কিন্তু সরকারি অনুষ্ঠানের যে নির্দিষ্ট কতগুলো প্রোটোকল আছে, সেটা মাঝে মাঝেই তিনি ভুলে যান। এই অনুষ্ঠানেও সেটাই দেখা গেল।
সরকারি অনুষ্ঠান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী আছেন, অর্থমন্ত্রী আছেন, লোকসভার স্পিকার আছেন। এই পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চে অমিত শাহ! এই মঞ্চে তাঁকে থাকতে নেই, এই বোধটা তাঁরও নেই। আর সরকারি কর্তাদেরও নেই। তিনি রাজ্যসভার সাংসদ, এর বাইরে আর কি সরকারি পোর্টফোলিও আছে! সাংসদ হিসেবেই যদি এমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে মঞ্চে জায়গা পাওয়া যায়, তাহলে তো সব সাংসদকেই ডাকতে হয়! অমিত শাহর উদ্দেশে একটা কথাই বলতে হয়, হিথায় তুকে মানাইছে নাই রে। এক্কেবারে মানাইছে নাই রে।
বাজপেয়ীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেক ভাল ভাল কথা বললেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরই চলে এলেন সেই ‘মুখস্থ করা গরুর রচনায়’। আসলে, ক্রমাগত বিরোধীদের ছোট করতে গিয়ে তিনি স্থান–কাল–পাত্র ভুলে যান। একতরফা আক্রমণ চলল বিরোধীদের বিরুদ্ধে। আর সেটা করতে গিয়ে নিজের অজান্তে বাজপেয়ীকেই ছোট করে বসলেন।
বিরোধীরা জোট করছে, এটাই ছিল তাঁর কটাক্ষের মূল বিষয়। বক্তৃতা শুনলে মনে হবে, জোট করাটা গহৃত কোনও অপরাধ। দুটো বা তিনটে দলের জোট মানেই ভয়ঙ্কর খারাপ কোনও জিনিস। তিন রাজ্যে শোচনীয় পরাজয়ের জ্বালা বা হতাশা থাকতেই পারে। তাই বলে, এই মঞ্চে সেগুলো তুলে আনা খুব জরুরি? বিরোধীরা সরকারি দলের বিরুদ্ধে জোট বাঁধবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। ভারতীয় রাজনীতিতে বারেবারেই এই ঘটনা ঘটেছে। এমনকী বিজেপি যে চারবার ক্ষমতায় এসেছে, সেই জোট করেই। তারও আগে, মোরারজি দেশাইয়ের সরকারও সেই জোট করেই এসেছিল। সেই সরকারেরই মন্ত্রী ছিলেন বাজপেয়ী ও আদবানি।
বাজপেয়ী ভারতীয় রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য, তার অন্যতম একটা বড় কারণ, তিনি পাঁচ বছর ধরে ২৩ টি দলের জোট সরকার চালিয়েছিলেন। সবাইকে নিয়ে চলতে পারতেন। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, তাদের হরেকরকম চাহিদা, এসব সামলে চলতে পেরেছিলেন। সেই কারণেই আজও বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের কাছে বাজপেয়ীর এই গুরুত্ব। কিন্তু মোদিবাবু সেসব বুঝলে তো! তিনি বিরোধীদের জোটকে তুচ্ছ করতে গিয়ে জোটকেই ছোট করে দেখাতে গেলেন। ফলে, বাজপেয়ীকে শ্রদ্ধা জানানোর মঞ্চে বাজপেয়ীকেই ছোট করে বসলেন।
মুদ্রা প্রকাশের অনুষ্ঠান। কিন্তু মুদ্রাদোষে সেটা ম্লান হয়ে গেল।