সমর্থকের মৃত্যুতে আনন্দ পায়!‌ এরা আদৌ ফুটবল ভালবাসে!‌

এক ফুটবল–‌পাগল দর্শকের মৃত্যু। অথচ, তা নিয়েও কিনা সোশ্যাল সাইটে বিদ্রুপ চলছে!‌ এই বিকৃত মনের লোকেরা ফুটবলকে ভালবাসে!‌ এমন সমর্থকেরা যে কোনও ক্লাবেরই লজ্জা। লিখেছেন কুণাল দাশগুপ্ত।।

মটকাটা গরম হওয়ারই কথা। ভাবছিলাম, দুর্গাপুজোর আগে শরৎকালের একটা দুরন্ত ছবি দেব স্যারকে। নীল আকাশ, সাদা তুলোর মতো মেঘ। কাক, চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। রঙ, তুলি নিয়ে বসেছি, হঠাৎ কান ফাটিয়ে, হার্ট কাঁপিয়ে বাজ পড়ার আওয়াজ। হাত থেকে জলের গ্লাসটা পড়ল কাগজে। জলের সুনামিতে কল্পনার রং উধাও। আর ছবি আঁকার চেষ্টাই করলাম না। পরের দিন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে স্যারের ঘরে ঢুকলাম। আমাদেরই কাগজ পড়ছিলেন। খানিকটা পৃথ্বীরাজ কাপুরের স্বরে বললেন, বুঝলে হে গোত্র গুপ্ত, মানুষ আর আজ মানুষের পাশে নেই। রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ে রয়েছে। কেউ এগিয়ে আসেনি। দেখো, আমাদের কাগজেই আছে।’‌ মানুষ যে আর মানুষের পাশে নেই, এ নিয়ে একটা ছবি আঁকো না।

এ আর কী এমন কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট, দু মিনিটে এঁকে ফেলব। আঁকলামও।
সম্পাদকমশাইকে দেখালাম। হতবম্ব স্যার বললেন, এ কী, কিছু লোক গ্রেড ডেন, ল্যাবরাডর, অ্যালসেশিয়ান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!‌
বললাম, এই যে বললেন, মানুষের পাশে আজ আর মানুষ থাকে না। তাই মানুষের পাশে কুকুরের ছবি আঁকলাম।
ওরে মূর্খ, তা বলিনি। মানুষের মনষ্যত্ব হারিয়েছে। মানুষ আজ অমানুষ। এটাই বলতে চেয়েছি।
বললাম, ঠিক আছে স্যার, এনে দিচ্ছি।
ভাবছি কী আঁকব। লি ক্যাম্পা!‌ মাথায় চলে এল, এঁকেও ফেললাম। দিয়ে এলাম সম্পাদক মশাইয়ের ঘরে। স্যার মিনিট খানেক আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করলেন। হুঙ্কার ছেড়ে বললেন— শর্মিলা ঠাকুরের কোলে উত্তম কুমার শুয়ে আছে, এঁকে নিয়ে এলে কেন?‌
মৃদু স্বরে বললাম, স্যার, আপনি অমানুষের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। এই সিনেমার যদি হই চোরকাটা ওই শাড়ির খাঁজে গানটার দৃশ্যটা নেট থেকে নিয়ে এঁকে ফেললাম।
বিকট চিৎকার করে স্যার বললেন, ‘‌মর্কট, তোমার মাথায় কি ভগবান অস্ট্রেলিয়ান জার্সি গরুর গোবর পুরে দিয়েছে?‌ আমি বলছি, মানুষের মানবিক গুণগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, এটা ছবির মাধ্যমে তুলে ধরতে। তোমার বউ কি পণ নিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলেন?‌ দূর হও। কাজের কাজ করো।’‌

ভেবেই চলেছি কী আঁকব। ইউরেকা!‌ পেয়ে গেছি। এঁকে হাজির করলাম স্যারের কাছে। স্যার এবারও হতবম্ব হয়ে বললেন, মানেটা কী?‌ গ্যালারিতে কিছু ভূত মদ খাচ্ছে?‌ তাদের গায়ে আবার সবুজ মেরুণ টি শার্ট!‌ কী বলতে চাইছো, বলো তো?‌’‌

fb post

বললাম, স্যার, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব অন্তপ্রাণ অর্ণব বসুর অকাল প্রয়াণে যখন সবাই শোকস্তব্ধ, তখন এই অর্বাচীন মোহনবাগান সমর্থকটি সোশ্যাল মিডিয়ায় এই পোস্টটা করেছে। তাকে আবার কেউ কেউ সাপোর্ট করছে। এদের মনুষ্যত্ব আছে?‌ খবরটা শোনার পর থেকে বুক ফেটে যাচ্ছে। রক্তাক্ত হচ্ছে হৃদয়। যারা সত্যিকারের ফুটবল ভালবাসে, তাদের তো এভাবেই কষ্ট পাওয়ার কথা। এমনকী সত্যিকারের মোহনবাগান সমর্থকরাও নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু এই অমানুষগুলোর জন্য আমাদের যেমন রাগ হচ্ছে, মোহন সমর্থকদেরও বোধ হয় লজ্জা হচ্ছে। অর্ণবের মতো ছেলেরাই তো দেশের সম্পদ। এরা না থাকলে কলকাতার ফুটবল মরে–‌পচে ফসিল হয়ে যেতে পারত। আজ থেকে একশো বছর পরও যদি কেউ ইস্টবেঙ্গল মাঠে যায়, সবুজ ঘাসে কান পাতে, শুনতে পাবেন রবি ঠাকুরের সেই অমর সুর, আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।
দেখলাম স্যারের চোখের কোণটাও চিকচিক করছে। জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে ক্যাপশান?‌
‘‌পিশাচ কখনও হয় না মানুষ‌।’‌
চোখের জল মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.