আজ বিভূতিভূষণের জন্মদিন। তাঁর সাহিত্যের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়। বরং সেই পড়ার মুগ্ধতা, চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার পটভূমি উঠে এল অন্তরা চৌধুরির লেখায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয় কখন তা সঠিক মনে নেই। প্রথম তাঁর কোন লেখা পড়েছিলাম তাও মনে নেই। কিন্তু তিনিই প্রথম কল্পনার জাল বুনতে শিখিয়েছিলেন। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে নিজের ভেতরে তৈরি হত এক অদ্ভুত কল্পলোকের জগৎ। চোখের সামনে অদৃশ্যভাবে সব যেন ঘটে চলেছে। আমি তখন আমি নই। সেই গল্পে বর্ণিত চরিত্র যেন আমি। তাঁর আনন্দে আমার আনন্দ। তাঁর কষ্টে আমার কষ্ট। বিভূতিভূষন কী সাবলীলভাবে তাঁর পাঠককে কখনও হাসান কখনও কাঁদান।

সেভেন বা এইটে পড়েছিলাম ‘পুঁইমাচা’। গল্পটা বড় সুন্দর। কোথায় যেন নস্টালজিয়ার সুর। বড় হয়ে গল্পটা যতবারই পড়েছি ফিরে গেছি ক্ষেন্তিদের গ্রামে। পৌষ সংক্রান্তিতে প্রথম পিঠে সাঁড়া ষষ্ঠীকে দিয়ে আসার দৃশ্য যেন আমি চোখের সামনেই দেখতে পাই। ক্ষেন্তির শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার দৃশ্য, খোকাহওয়ার কথায় তাঁর চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়ার দৃশ্য, সব যেন নিজের মনের রঙ্গমঞ্চে আপন মনে অভিনীত হয়ে চলে। কিন্তু ক্ষেন্তির পরিণাম, তাঁর মৃত্যু বড় মর্মান্তিক। ক্ষেন্তির জন্য বড় কষ্ট হয়। কেমন যেন অব্যক্ত একটা কষ্ট যা কাউকে বোঝানো অসম্ভব।
এরকম একটা গল্প ছিল ‘জলসত্র’। জৈষ্ঠ্য মাসের প্রচণ্ড গরমে প্রকাণ্ড একটা মাঠ পেরোতে গিয়ে মারা গিয়েছিল একটি বাচ্চা মেয়ে। তারই নামে তাঁর দাদা সাধারণ মানুষের জন্য খোলে জলসত্র। গল্পের আঙ্গিক বিচারে না হয় নাই গেলাম। কিন্তু তাঁর অনেক গল্পের ভিড়ে আলাদা করে মনে রাখার মতো এই গল্প। গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, আমরাও বুঝি জৈষ্ঠ্যের দুপুরে ওই মাঠা পেরোচ্ছি। তেষ্টায় আমাদের প্রাণও বুঝি যায় যায়। এমনই তাঁর বর্ণনার গুণ।

‘পথের পাঁচালী’র অপু দুর্গার অবাক বিস্ময়ের সঙ্গী আমরাও। দুর্গার সত্তার সঙ্গে আমার সত্তাও কোথাও যেন অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ‘আরণ্যক’ পড়েই বোধহয় প্রথম জঙ্গলের প্রেমে পড়ে গেলাম। পাতার পর পাতা জুড়ে শুধুই বিস্ময়। মুগ্ধতা। এখনও ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটার দিকে তাকালেই মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে ওঠে। মনে হয়, ওই বইটার মধ্যে এক অফুরন্ত আনন্দের জগৎ আছে। ইচ্ছে হলেই টুক করে সেই জগতে নাওয়া খাওয়া ভুলে হারিয়ে যাওয়া যায়। নিমেষের মধ্যে চলে যাওয়া যায় পূর্ণিয়ায়। দেখা করা যায় টাঁড়বারোর সঙ্গে। সত্যচরণের সঙ্গেই রাজা দোবরুপান্নার অতিথি হওয়া যায়। আর বড্ড ইচ্ছে করে একটা আয়না উপহার দিয়ে ভানুমতীর সঙ্গে গল্প করার। ‘ভারতবর্ষ কোন দিকে’ এই প্রশ্নের উত্তর দেবার। সত্যচরণের সঙ্গে ডাইনী জ্যোৎস্নায় জঙ্গলের মাঝে ঘুরে বেড়ানো, আর ডামাবানু দেখার দৃশ্য কী কখনও ভোলা যায়!
সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ার কারণে বিভূতিভূষণের সাহিত্যের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনেক করেছি। কিন্তু তাঁর লেখা পড়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা সেখানে বলা একেবারেই নৈব নৈব চ! আজ তাঁর জন্মদিনে এটুকুই তাঁকে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
