দলহীন সোমনাথের বিরুদ্ধেও নালিশ করতে হল!

(আজ ঘটা করে তাঁকে গান স্যালুট দেওয়া হল। অথচ, বছর তিন আগে এই সোমনাথ চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে নির্বাচন কমিশনে ছুটে ছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি, শোভন চ্যাটার্জিরা। সেই সময় বেঙ্গল টাইমসে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তার লিঙ্ক দেওয়া হল। পাঠকেরা চাইলে পড়তে পারেন। ) 

সত্যিই চরম সংকট। সোমনাথ চ্যাটার্জি, অশোক গাঙ্গুলিদের আইন শেখাচ্ছেন শোভন চ্যাটার্জি, পার্থ চ্যাটার্জিরা। ‘দলহীন’ বর্ষীয়াণ সোমনাথ চ্যাটার্জি একটা ভাষণ দিলেন। নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানাতে ছুটতে হল শিক্ষামন্ত্রী-মেয়রকে। সঙ্গে স্বনামধন্য শঙ্কুদেব পন্ডা। কতটা দেউলিয়া, আবার ওঁরা নিজেরাই প্রমাণ করে দিলেন।।

লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।

একটা দল কতটা দেউলিয়া হতে পারে, কতটা নির্লজ্জ হতে পারে, প্রতিদিন তার প্রমাণ রেখে চলেছে শাসক দল। একেকদিনের অসভ্যতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে আরেকদিনের অসভ্যতা।

জেলার ৯১ টি পুরসভার ভোটের আগে বিভিন্ন জেলায় কীভাবে হুমকি, বাড়ি জ্বালানো, গুন্ডা সাপ্লাই চলছে, সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। অন্য একটি বিষয়ে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে এই লেখা।

গতকাল অবাধে ভোটের দাবিতে সমবেত হয়েছিলেন রাজ্যের বিদ্বজ্জনেরা। ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, অশোক গাঙ্গুলি, মীরাতুন নাহার, সমীর আইচ, কৌশিক সেনদের মতো মানুষেরা। মানুষ যেন অবাধে ভোট দিতে পারে, প্রশাসন যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, এই ছিল তাঁদের দাবি।

আজ তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে গেলেন পার্থ চ্যাটার্জি, শোভন চ্যাটার্জিরা। একজন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী । একজন এই শহরের মেয়র (এবারও তিনিই মেয়র হতে চলেছেন)। তাঁদের দাবি, অ্যাকাডেমির সামনে সভা করে সোমনাথবাবুরা বিধিভঙ্গ করেছেন। তাঁদের যেন শাস্তি হয়।

এ রাজ্যে সত্যিই বড় সংকট। সুপ্রিম কোর্টের  প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি বা স্বনামধন্য আইনজীবী ও লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জিকে আইনের শিক্ষা দিচ্ছেন পার্থ চ্যাটার্জি-শোভন চ্যাটার্জিরা। এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা শ্রীমান শঙ্কুদেব পন্ডা।

somnath3

১) কলকাতায় ভোট পেরিয়ে গেছে ১৮ এপ্রিল। তারপর সভা হলে কী করে নির্বাচনী বিধিভঙ্গ হয়, মাথায় ঢুকছে না।

২) সভাস্থলে কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা ছিল না। যাঁরা মূল উদ্যোক্তা, তাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। রাজৈতিক মিটিং মিছিলে  সাম্প্রতিককালে এঁদের দেখা যায়নি।

৩) পার্থবাবুর দাবি, যাঁরা ছিলেন, তাঁরা দলের পতাকাবাহী। কোন দলের, একটু স্পষ্ট করে বলবেন ? একমাত্র সোমনাথবাবু ছাড়া কেউই সেভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনিও প্রায় সাত বছর হল, দল থেকে বহিস্কৃত। অশোক গাঙ্গুলি কোন দলের ? কোনও রাজনৈতিক সভায় কোনওদিন দেখেছেন ? সমীর আইচ তো দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের হয়ে ? কৌশিক সেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে বামফ্রন্টের তীব্র সমালোচক ছিলেন।

৪) ওই সভায় শাসকের সমালোচনা হয়েছে, এটা ঘটনা। কিন্তু কোনও দলকে ভোট দেওয়ার আহ্বান কি জানানো হয়েছিল ? একজনও জানিয়েছিলেন ?

৫) মানছি, জেলায় ভোট এখনও বাকি। পঞ্চায়েত বা পুরসভার ক্ষেত্রে যে এলাকায় ভোট, সেই এলাকায় নির্বাচনী বিধি কার্যকর থাকে। কলকাতায় সভা করলে কী করে বিধিভঙ্গ হয়, মাথায় ঢুকছে না

৬) একটু অন্যভাবে ভাবুন। কলকাতায় ভোট হয়েছে ১৮ তারিখ। ১৬ তারিখ দুপুর থেকে প্রচার বন্ধ। কিন্তু জেলায় তো প্রচার বন্ধ হয়নি। কলকাতার প্রচার যদি জেলায় প্রভাব ফেলে, এই সর্বব্যাপী মিডিয়ার যুগে জেলার প্রচারও তো কলকাতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

৭) আপনি এই সভার বিরোধীতা করে রাজনৈতিক ভাষণ দিয়ে গেলেন। মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের সাফাই দিয়ে যাচ্ছেন। এটা বিধিভঙ্গ নয় ?

৮) যদি এক জেলায় সভা হলে অন্য জেলায় বিধিভঙ্গ হয়, তাহলে সবার আগে তো মুখ্যমন্ত্রী নিজে দায়ী। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পরে আলিপুরদুয়ারে সরকারি সভা ও একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণা করে এসেছেন। হ্যাঁ, আলিপুরদুয়ারে ভোট ছিল না। কিন্তু মাত্র কুড়ি মিনিট দূরে থাকা কোচবিহারে তো ছিল। পাশের জলপাইগুড়ি জেলায় তো ছিল। কোচবিহারের মাথাভাঙ্গার মানুষ যদি রবীন্দ্র সদন চত্বরে দেওয়া সোমনাথ চ্যাটার্জির ভাষণে প্রভাবিত হন, তাহলে কুড়ি মিনিট দূরে মুখ্যমন্ত্রীর সফরেও প্রভাবিত হতে পারেন। বেশি পুরানো উদাহরণ দরকার নেই। গতকালই ৬ টি স্মার্ট সিটির কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। একেবারে সরকারি ঘোষণা। রাজ্যে ৯১ টি পুরসভায় একদিন পর ভোট। এই অবস্থায় এরকম ঘোষণা করা যায় ? এটা বিধিভঙ্গ নয় ? স্পষ্ট বক্তব্য জানতে চাই।

৯) দলহীন সোমনাথ চ্যাটার্জিকে এত ভয় ? কী বলেছিলেন তিনি ? ‘জীবনের শেষ সীমান্তে এসে যা দেখছি, তা ভাল লাগছে না। এ কোন বাংলা ? প্রতিদিন এত মারামারি, হানাহানি হচ্ছে কেন ? পুলিশের ভূমিকাই বা এত একপেশে কেন ?’ একজন প্রবীণ মানুষের এই কথাগুলোর জন্যে নালিশ করতে হচ্ছে ? এত দেউলিয়া হয়ে গেলেন ?

১০) সবচেয়ে মজা পেলাম আপনার আরেকটা মন্তব্যে। আপনার কথায়, ওরা যদি বিদ্বজ্জন হয়, তাহলে আমরা আমাদের বিদ্বজ্জনদের দিয়েও প্রচার করাব । ‘আমাদের বিদ্বজ্জন’ ? কথাটা ভেবে বল‌েছেন তো ? তাহলে মেনেই নিলেন, আপনাদের বিদ্বজ্জন !

somnath4

১১) বারবার বললেন, ‘ওঁরা কেউ বিদ্বজ্জন নন। ওরা পতাকাধারী।’ কে পতাকাধারী, নামটা একটু বলুন না। সত্যিই তো, অশোক গাঙ্গুলি বা সোমনাথ চ্যাটার্জিরা শিক্ষিত বা বুদ্ধিজীবী হতে যাবেন কোন দুঃখে! বুদ্ধিজীবী হলেন জুন মালিয়া, বাহামনি, হরনাথ বা ইন্দ্রনীলরা।

১২) আপনাদের শিবিরের একজন বিদ্বজ্জনের নাম বলুন, যাঁকে নেত্রীর সঙ্গে মিছিলে হাঁটতে হয়নি! কখনও ব্রিগেডের দলীয় মঞ্চে তুলেছেন। কখনও জালিয়াতদের গ্রেপ্তার করা হলে প্রতিবাদে পথে নামিয়েছেন। এমনকি শেরিফকেও রাজনৈতিক মঞ্চে তুলে দিয়েছেন। ওই বিদ্বজ্জনদের আর কত নিচে নামাবেন ?

১৩) বহুযুগ আগে থেকে কথাটা চালু আছে। যে যেমন মানুষ, সে তেমন সঙ্গী ঠিক খুঁজে নেয়। তাই আপনাদের চারপাশে সেই সব মেরুদন্ডহীন মানুষকেই পেয়েছেন। দেখুন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। যিনি একবার ‘হ্যাঁ’ বললেই যেতে পারতেন রাজ্যসভায়। একবার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেই হতে পারতেন কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল বা কোনও দেশের রাষ্ট্রদূত। কী জানি, হয়ত একটু তদ্বির করলে উপরাষ্ট্রপতিও হতে পারতেন। কী অবলীলায় ফিরিয়ে দিলেন। আর আপনাদের শিবিরে থাকা ওই বিদ্বজ্জনরা ! সামান্য একটা ‘বঙ্গভূষণ’ বা দু একটা সরকারি প্রোগ্রামের জন্য কী অবলীলায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন।

১৪) শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তো মানুষ কিছু শিষ্টাচার আশা করে। কিন্তু কথা শুনলে মনে হয় না, শিক্ষার সামান্যতম ছাপ আছে। দলীয় বাধ্যবাধকতা থাকতেই পারে। তাই বলে প্রতিদিন এমন ডাঁহা মিথ্যে বলতে হয় কেন ? যতই হোক, শহরটার নাম তো কলকাতা। রাজ্যটার নামতো বাংলা। সেই শহরের মেয়র, সেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী (সর্বোপরি আরও একজন) প্রতিদিন নিয়ম করে এমন ডাঁহা মিথ্যে বলেন কী করে ? একটু চক্ষুলজ্জাও কি থাকতে নেই ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.