রাষ্ট্রের কাছে কিশোর ছিলেন ব্রাত্য। কিন্তু ফিল্মফেয়ার! হিসেবে বলছে, আটবার এই পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু যে গানগুলোর জন্য পেলেন, আর যে গানগুলোর জন্য পেলেন না, তা একবার মিলিয়ে দেখুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন, ফাঁকিটা কোথায়। বছর ধরে ধরে, সেই হিসেবটাই মেলে ধরলেন কুণাল দাশগুপ্ত।।
ঠিক ভিভ রিচার্ডসদের মতোই। তাঁর সেরা সময় ভিভ যেমন উইলো দিয়ে ছেলেখেলা করতেন, কিশোর কুমারও ভোকাল কর্ড দিয়ে করতেন সুরের জাগলিং। তবু ভারত নামক ভূখণ্ডের প্রভুরা তাঁর জন্য কোনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বরাদ্দ করেননি।
কিশোর কুমার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অবশ্য সবথেকে বেশি পেয়েছিলেন। ৮ বার। সবথেকে বেশি মনোনয়নও পেয়েছেন কিশোর কুমার। ২৭ বার। একই বছরে সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন পেয়েছেন কিশোর কুমারই, চারবার। এই তথ্য দেখে যদি মনে হয়, ফিল্মফেয়ার পত্রিকাগোষ্ঠী তৃতীয় গাঙ্গুলির উপর নিদারুণ সদয় ছিলেন, তাহলে আপনি ভগবৎ চন্দ্রশেখরের গুগলির সামনে পড়লেন।
কিশোর কুমার ১৯৪৮ সাল থেকে প্লে ব্যাক করছেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৯ সাল থেকে সেরা প্লে ব্যাক সিঙ্গার বাছার কাজটা শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ শিঁকেটি ছিড়তে সময় লেগেছিল ১১ বছর। ১৯৭০ সালে ‘আরাধনা’ ছবির ‘রুপ তেরা মস্তানা’র জন্য প্রথম ফিল্মফেয়ার পান কিশোর। এরপর পাক্কা ছয় বছর পর দ্বিতীয়বার সেরা গায়ক হন, অমানুষ (হিন্দি) ছবিতে ‘দিল অ্যায়সা কিসিনে মেরা তোড়া’ গাওয়ার জন্য। তৃতীয়বার পেলেন ১৯৭৯ সালে ‘খাইকে পান বানারসওয়ালা’তে। ‘থোড়ি সি বেওয়াফাই’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে হাজার রাহে’ গেয়ে চার নম্বর ফিল্ম ফেয়ারটি পেয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে, পান ‘পগ ঘুঙরু’র জন্য। ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে ‘আগর তুম না হোতে’ টাইটেল সঙ গেয়ে ছয় নম্বর পুরস্কারটি হাসিল করেন কিশোর। সাত নম্বরটি পান ‘শরাবি’ ছবিতে ‘মনজিলে আপনি জাগা’। আর সব শেষে সাগর–এর টাইটেল সঙ। বেয়াড়া প্রশ্নটি হল, পেলেন তো এইসব গানের জন্য। কিন্তু কোন কোন গান গাওয়ার পরেও কিশোর কুমার পুরস্কার পেলেন না।
১৯৭১ সালে ‘প্যাহেচান’ ছবিতে ‘সত্য বড়া নাদান’ ছবির জন্য মুকেশ ফিল্ম ফেয়ার পান। কোনও সন্দেহ নেই যে, বিশাল বড় শিল্পী ছিলেন মুকেশ। কিন্তু ‘সত্য বড়া নাদান’–গানটিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হননি। বলা যেতে পারে, স্টুডিও থেকে বেরিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ে প্যাহেচান ছবির গান। অবাক কাণ্ড কিশোর কুমারের কোনও গানই নমিনেশন পায়নি সেই বছর।
১৯৭২ সালে এই পুরস্কার পান মান্না দে। এ ভাই জরা দেখকে চলো। ছবি— মেরা নাম জোকার। কিশোর কুমারের ‘কটি পতঙ্গ’–এর ‘ইয়ে যো মহাব্বত হ্যায়’ নমিনেশনে ছিল। জনপ্রিয়তা এবং গানের মানের বিচারে কোনটা এগিয়ে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। রাজ কাপুরের অদৃশ্য হাত হিন্দি ছবির জগতে অনেক অনিষ্ট করেছে। এক্ষেত্রে সেটাই কাজ করেছে কিনা, তা গবেষকরাই বলতে পারবেন। আমরা আমজনতা বলতে পারি, কিশোর কুমারকে পত্রিকাগোষ্ঠী পিছন থেকে কাঁচি মেরেছিলেন। রেফারি নেই, ফাউল কে দেবে!
১৯৭৩ সাল। পুরস্কার পেলেন মুকেশ। গানের নাম–জয় বোলো বেইমানকি। ছবি: শোর। পেল না নমিনেশনে থাকা ‘অমর প্রেম’ ছবিতে অমর শিল্পীর অমর গান ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে।’ নমিনেশনই পেল না ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’। ফিল্মি দুনিয়ায় অসৎ মানুষের আনাগোনা বেশি হলে সঙ্গীতের সঙ্গে বেইমানি করাটা সহজ হয়ে যায়। সেই কারণেই ঘুরে ফিরে জয়জয়কার হয়েছে ‘জয় বোলো বেইমানকি’র মতো কূলগোত্রহীন গানের।
১৯৭৫ সালে মহেন্দ্র কাপুর পেলেন ফিল্ম ফেয়ার। গাইলেন, ‘রোটি কাপড়া আউর মকান’ এ ‘অউর নেহি, অউর নেহি, বাস অউর নেহি’। কী কাণ্ড! ওই বছরই কিশোর কুমারের মেরা জীবন কোরা কাগজ’ নমিনেশন পায়। কিন্তু ভাল গানের জন্য পুরস্কার অধরা। ১৯৭৭ সালে আবার মুকেশ ফাটালেন। কভি কভি–র টাইটেল সঙ গেয়ে। কিশোর কুমারের ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ নমিনেশন পেলেও বিচারকদের সততা বা অতি পাণ্ডিত্যের জন্য বঞ্চিত হতে হয়েছে। এমনভাবেই ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নমক হারাম–ছবিতে গাওয়া ‘ম্যায় শায়ার বদনাম’ কিশোর কণ্ঠকে পুরস্কার দিতে ব্যর্থ।
নমিনেশন, ইলেকশন বা সিলেকশন বলিউডে কোনওদিন ‘ফেয়ার’ ছিল না। তাই ফিল্মফেয়ার পুরস্কার চিরদিনই ফেয়ারনেস–এর অভাবে ভুগেছে। ভাবা যায়, কিশোর কুমারের ‘জিন্দেগি কা সফর’, ‘জিন্দেগি কে সফর মে গুজর’ কিম্বা ‘কিসকা রাস্তা দেখে’ নমিনেশন পর্যন্ত যেতে পারেনি! কিশোর কুমার লাগাতার ফিল্মফেয়ার পেতে শুরু করলেন যখন মুকেশ–রফি প্রয়াত হয়েছেন। ফিল্মি দুনিয়া থেকে অনেকটাই সরে গেছেন মান্না দে। তখন পিঠ বাঁচাতে নিম্নমানের গানের জন্য কিশোরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যেগুলোকে কিশোরের সেরা গানের তালিকাতেই রাখা যায় না।
মিথ আছে, নামী সুরকাররা নাকি ফিল্মফেয়ার কিনে নিতেন। শোনা যায়, অভিমান পুরস্কৃত হওয়ার পর স্বয়ং এসডি বর্মন নাকি শঙ্কর জয়কিশেনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা অভিমানবশত এই কেনাবেচার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
যাই হোক, বাঙালিদের নামের পেছনে কুমার যোগ থাকলেই হিস্টামিন সিক্রেশন হেরে যেত। প্রবল অ্যালার্জি যাকে বলে। প্রয়াত কিশোর কুমারের সঙ্গে অন্তহীন কুস্তি চললেও জনগণের মনের রিঙ–এর বাইরে ছিটকে ফেলতে পারেননি ছিচকেরা। সাহিত্য, বিনোদন ও শিল্পের জগতে একজন বিচারকের কথা খুব শোনা যায়— মহাকাল। তার বিচারে যে টেকার, টিকে যায়। যে হারানোর, সে হারিয়েও যায়। সেখানে রাষ্ট্রের ফতোয়া, প্রভাবশালীর প্রভাব, এগুলো ধোপে টেকে না।
আটটা ফিল্ম ফেয়ার তাই বোকা বানানোর প্রচেষ্টা মাত্র। আর আপনি যদি আটখানা ফিল্ম ফেয়ার–এর জন্য আহ্লাদে আটখানা হন, তাহলে পিছনে তাকিয়ে দেখবেন, আপনার স্টাম্প নড়ে গিয়েছে। এঁরা ভগবৎ চন্দ্রশেখরের চেয়েও ভয়ঙ্কর যে!