কেকা ঘোষাল
আমাদের মাথার উপর সুর্য আছে। সারাদিন আলো দিযে যায়। ঠিক তেমনি আমাদের মাথার উপর লতা মঙ্গেশকার আছেন। কখনও তিনি সূর্য হয়ে আলো দেন। আবার কখনও বনস্পতি হয়ে দেন ছায়া।
দেখতে দেখতে মুম্বই আসা প্রায় বারো বছর হতে চলল। এত শিল্পীকে কাছ থেকে দেখেছি, অনেকের সঙ্গেই দেশে-বিদেশে নানা অনুষ্ঠান করেছি। অথচ, লতাজিকে সভাবে কখনও কাছে পাইনি। যদি কাছে পাই, কী বলব ? অনেককিছু হয়ত বলতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু আমি তো নিজেকে চিনি। আবেগে হয়ত কথাই বলতে পারব না। আমার কাছে লতা মঙ্গেশকার, আশা ভোঁসলেরা হলেন সাক্ষাৎ সরস্বতী।
দেশের নানা প্রান্তে, এমনকি বিদেশেও প্রবাসীদের আমন্ত্রণে যখন অনুষ্ঠান করতে যাই, ঘুরে ফিরে লোকে লতা-আশার গানই শুনতে চায়। তাঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করি। যত এগোতে থাকে, দর্শকরা এই দুই কিংবদন্তির গানই বেশি করে শুনতে চায়। একের পর এক চিরকুট আসে, দাবি আসে। অনুষ্ঠানের আগেও দর্শকরা ফেসবুক বা হোয়াটস আপে এরকম আবদার জানিয়ে বসেন।
আমার প্রিয় কে ? অবশ্য আশাজির গান গাইতেই বেশি পছন্দ করি। আশাজিকে সবসময় মহাভারতের কর্ণের মতো মনে হয়। ভাল ভাল গানগুলো কিন্তু আশাজিকে দেওয়া হয়নি। ওই গানগুলো গাওয়া যে কত কঠিন, নিজে গান গাই বলেই কিছুটা বুঝতে পারি। ওইসব গানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা একমাত্র আশাজির পক্ষেই সম্ভব ছিল। অন্য কেউ গাইলে গানগুলো কোথায় হারিয়ে যেত! কেউ জানতেও পারত না।
লতাজি মূলত বিশেষ একধরনের গান গেয়ে গেছেন। যে গানের মধ্যে উদ্দামতা নেই। আছে এক শান্ত নদীর ছবি। আছে এক পবিত্রতার অঙ্গিকার। যেখানেই যাই, বাঙালি তো থাকেই। আর আমি বাংলা থেকে উঠে আসা শিল্পী। ফলে, আমার কাছে বাংলা গানের আবদার আসবেই। জুঁই সাদা রেশমি জোছনায়, দূরে আকাশ সামিয়ানা, কী লিখি তোমায়, ভালবাসার আগুন জ্বেলে- এই গানগুলো যখন গাই, তখন শ্রোতাদের চোখেমুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি দেখতে পাই। তৃপ্তি পাই নিজেও। হিন্দিতে বেশি গাই ‘অ্যায় দিল এ নাদান’, ‘হোঁটো পে অ্যায়সি বাত’, ‘জিয়া জলে’- এই গানগুলো।
লতাজির সঙ্গে গান গাইতে না পারলেও আশাজির সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আই পি এল টু-তে একই ট্র্যাকে আশাজির সঙ্গে গেয়েছিলাম। ইয়াশরাজ স্টুডিওতে রিহার্সাল হয়েছিল। উদ্বোধনের সময় লাইভ প্রোগ্রাম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেবার রাতারাতি আই পি এল ভারত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটাই আর হল না। এই আক্ষেপটা সারাজীবন থেকে যাবে। এছাড়াও আমার মুম্বইয়ে আসার শুরুর দিকে একটা রিযেলিটি শোয়ে তিনি জাজ ছিলেন। সুযোগ হয়েছিল তাঁকে নিজের গান শোনানোর।
মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই, এই বয়সেও দুই বোনের গলা এত সজীব থাকে কী করে ? কত গায়িকাকে দেখলাম। পঞ্চাশ বা ষাট পেরোতেই হারিয়ে গেলেন। কিন্তু লতাজি-আশাজি যেন চিরতরুণী। এর একটাই কারণ, পরিশ্রম, একাগ্রতা আর সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা। আমাদের মধ্যে এর ছিঁটেফোঁটাও নেই। যতবার ওই বাড়ির পাশ দিয়ে পেরোই, মনে হয় যেন কোনও মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। জানি না, কখনও সঙ্গীতের ওই মন্দিরে ঢোকার সুযোগ হবে কিনা।
বয়স হয়ে গেছে। এখন আর সেভাবে গাইতে পারেন না। তবু চাইব, উনি শতায়ু হোন। আমার সরস্বতীর কাছে আমার একটা আর্জি আছে। উনি নিজে কীভাবে লড়াই করে উঠে এসেছিলেন, আজও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু দেশের নানা প্রান্তে অনেক প্রতিভা অকালেই ঝরে যাচ্ছে। যারা জীবনযুদ্ধে লড়াই করে পেরে উঠছে না। তাদের লড়াইয়ের পাশে যদি উনি থাকেন, তাহলে ভারতীয় সঙ্গীত আরও এগিয়ে যেতে পারে। আমি চাই, লতাজি এমন একটা ট্রাস্ট খুলুন, যে ট্রাস্ট সেই অভাবী অথচ গুণী শিল্পীদের পাশে দাঁড়াবে, লড়াই করার সাহস জোগাবে।
(লেখিকা মুম্বইয়ের একজন বিশিষ্ট প্লে ব্যাক সিঙ্গার। )