লাইব্রেরিতে মার্কস–লেনিনের বই কেন থাকবে? এসব বই রাখা চলবে না। বামেদের কোনও বই রাখা চলবে না। কার্যত ফতোয়া জারি করলেন এক ক্যাবিনেট মন্ত্রী। তাও আবার গ্রন্থাগারমন্ত্রীর সামনে। কোনদিন হয়ত বলবেনস নেতাজির বইও থাকবে না। এমন হুমকি যিনি দিচ্ছেন, কী আশ্চর্য, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ! লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
বিশ্বকাপের আড়ালে কতকিছু চাপা পড়ে যাচ্ছে! আর জেলার ঘটনা হলে তো কথাই নেই। শোভনবাবু বৈশাখীর সঙ্গে কোর্টে যাচ্ছেন, সেই খবর কাগজে জায়গা পাচ্ছে। অথচ, দক্ষিণবঙ্গে বা উত্তরবঙ্গে কী সব কাণ্ড ঘটছে, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথাও নেই।
ঘটনাটি মঙ্গলবারের। উত্তরবঙ্গ সফরে গেছেন রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি। সোমবার দুটি মিটিং করেছেন রায়গঞ্জ ও শিলিগুড়িতে। মঙ্গলবার তাঁর গন্তব্য ছিল কোচবিহার। যথারীতি হাজির মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, জেলাশাসক, আরও কেউ কেউ।
রবীন্দ্রনাথ ঘোষ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। সিপিএম নেই, তারপরেও লাইব্রেরিতে কেন মার্কস–লেনিনের বই থাকবে? এসব রাখা চলবে না। বাম মনোভাবাপন্ন কোনও বই রাখা চলবে না। এসব বই আছে বলেই নাকি পাঠকেরা লাইব্রেরিতে আসেন না। এসব বিদেয় করতে হবে। কেন এতদিন এই বইগুলো যত্ন করে রাখা আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভাবা যায়, সরকারি মিটিংয়ে একজন মন্ত্রী এই কথা বলছেন? শুধু মিটিংয়ে বললে তো কাগজে নাও বেরোতে পারে। অতএব, মিটিং শেষে প্রেস কনফারেন্সেও একই দাবি, মার্কস–লেনিনের বই লাইব্রেরিতে রাখা চলবে না। হ্যাঁ, এটাই সরকার। এটাই প্রশাসন। রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এইসব দাবি তুলছেন, গ্রন্থাগারমন্ত্রী ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছেন। তাঁর ভাষণও কার্যত রবীন্দ্রনাথ ঘোষের বেঁধে দেওয়া সুরে।
আপনি সিপিএমের তীব্র সমালোচক হতেই পারেন। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, আপনি মার্কস বা লেনিনের সমালোচকও হতে পারেন। তাই বলে, লাইব্রেরিতে এইসব বই রাখা চলবে না, এরকম ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে কিনা গ্রন্থাগারমন্ত্রীর সামনে! বেশ, মার্কস–লেনিন না হয় রইলেন না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই রাখা যাবে না? সুকান্ত ভট্টাচার্যের বইও রাখা যাবে না? রাহুল সংকৃত্যায়ণ বা সমরেশ বসুর বই রাখা যাবে না? কী জানি, বলবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইও রাখা যাবে না। হয়ত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর রচনাবলীও রাখা যাবে না। কী জানি, রাশিয়ার চিঠি লেখার জন্য রবি ঠাকুরও নিষেধাজ্ঞার তালিকায় চলে যেতে পারেন।
আসলে, লাইব্রেরি দপ্তরটা হয়ে উঠেছে ভুলভাল লোকেদের একটা পুনর্বাসনের জায়গা। ২০১১ থেকে ১৬, লাইব্রেরি মন্ত্রী কে ছিলেন? করিম চৌধুরি, যিনি বাংলা লিখতে তো দূরের কথা, পড়তে বা বলতেও জানেন না। ভাবতে পারেন, বাংলার গ্রন্থাগারমন্ত্রী, অথচ বাংলা পড়তে বা বলতে পারেন না! এবার হলেন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি। হিংসায় উস্কানি দেওয়া, শহর অচল করে দেওয়ার জন্যই যাঁর খ্যাতি, তিনি হলেন লাইব্রেরি মন্ত্রী। আর মন্ত্রীরাও একেকজন রত্ন।
নাম রবীন্দ্রনাথ হলে কী হবে, রবীন্দ্রনাথের লেখাও আদৌ পড়েছেন কিনা ঘোর সন্দেহ আছে। ছোটবেলায় টেক্সট বুকে পড়লেও গত কুড়ি–তিরিশ বছরে মন্ত্রীমশাই যে ছুঁয়েও দেখেননি, একথা হলফ করে বলা যায়। যাঁরা এই নাম রেখেছিলেন, তাঁরা বেঁচে থাকলে নির্ঘাত লজ্জা পেতেন। আর স্বয়ং রবি ঠাকুর বেঁচে থাকলে লজ্জায় হয়ত নিজের নামটাই বদলে ফেলতেন। বেশ, মার্কস–লেনিন পড়তে হবে না। গত দশ বছরে কোনও বই পড়েছেন? এমনকী সাহিত্যে ডিলিট পাওয়া নেত্রীর লেখা পড়েছেন? সেগুলোও আধঘণ্টা পড়ার ধৈর্য আছে? হয়ত ভাবছেন, পড়া খুব সহজ কাজ। কিন্তু অভ্যেস না থাকলে কতটা কঠিন, যাঁরা চেষ্টা করেছেন, তাঁরা জানেন। অভ্যেস না থাকলে যেমন এক কিমি ছোটা যায় না, তেমনি আধঘণ্টা পড়াও যায় না।
বছরখানেক আগের কথা। কোচবিহারে নাটক করতে গেছেন দেবশঙ্কর হালদার। ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত। তৃণমূলের জেলা সভাপতি বলে কথা। বসেছেন একেবারে সামনের সারিতে। নাটক চলছে, তিনি টেলিফোনে তারস্বরে কথা বলেই চলেছেন। একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল দেবশঙ্করের। বিনীতভাবে বলেই ফেললেন, ‘বুঝতে পারছি, আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ। দুজন একসঙ্গে কথা বললে তো মুশকিল। আপনি বরং কথা বলে নিন। ততক্ষণ আমি অভিনয় বন্ধ রাখি। আপনার শেষ হলে বলবেন, আমি নাটক শুরু করব।’ এরপরেও খোঁচাটা বোঝেননি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। ভাবলেন, তাঁকে বোধ হয় দারুণ সম্মান দেওয়া হল। কথা বলেই চললে। কথা শেষ হওয়ার পর হাত নাড়লেন, অর্থাৎ এবার নাটক শুরু হতে পারে। অর্থাৎ, তাঁর কথা বলা হয়ে গেছে, এবার তিনি অনুমতি দিলেন।
হ্যাঁ, এই লোকেরাই রাজ্যের মন্ত্রী। এই লোকেরাই তৃণমূলের জেলা সভাপতি। এবং এইসব উদ্ভট কর্মকান্ডের পরেও এঁদের পদোন্নতি হয়। সত্যিই, অনুপ্রেরণা বড় ভয়ঙ্কর জিনিস।