(অনেকদিন নীরব ছিলেন নন্দ ঘোষ। চারিদিকে এত বিশ্বপাক বিশ্বকাপ আওয়াজ। তিনি ঠিক করলেন, এবার ফুটবল নিয়েই লিখবেন। রাত জেগে খেলা দেখলেন, কাগজ পড়লেন। ফেসবুকে বিশেষজ্ঞদের ভাষণ শুনলেন। লিখে ফেললেন এক কিস্তি। )
এই এক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে। সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় নাকি GOAT. (Greatest Of All Time). আমরা বাপু ছাপোষা বাঙালি। গ্রেটেস্ট ফ্রেটেস্ট বুঝি না। GOAT মানে বুঝি ছাগল। বড়সড় ছাগল হলে রামছাগল। (দয়া করে রাম শব্দের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা খুঁজবেন না। কারণ ছাগল একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রাণী, তাই একে খোদার খাসিও বলা হয়।) সে যাই হোক, ইদানিং দেখছি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়কে GOAT বলার রেওয়াজ চালু হয়েছে।
কেউ বলছে মেসি GOAT, কেউ বলছে রোনাল্ডো, কেউ আবার বলছে নেইমার কালে কালে GOAT হয়ে উঠবে। আমি বলছি, এবারের বিশ্বকাপে প্রমাণ হয়েছে এরা তিনটেই GOAT। না না সর্বকালের সেরা অর্থে নয়, ছাগল অর্থে।
প্রথমেই আসুন নেইমারের কথায়। বাংলায় জন্মে কবিতা লিখলেই যেমন সবাই রবীন্দ্রনাথ হয় না। তেমনি ব্রাজিলে জন্মে ফুটবল খেললেই সবাই পেলে হয় না। কিন্তু নেইমারের হাবভাব দেখলে মনে হয় পেলের বাবা। চুলের ছাঁট দেখলে মনে হয় জাভেব হাবিবের ঠাকুরদা। খেলার নামে লবডঙ্কা, বাক্যির জোর ষোলোআনা। বার্সিলোনায় খেলব না, তাহলে মেসির চাপে ঢাকা পড়ে যাব। বিশ্বকাপে তো পাশে মেসি নেই, কী হাতি ঘোড়া মারছিস? সুইজারল্যান্ডকে হারাতে পারিস না। ফ্রান্স-জার্মানি-স্পেন সামনে পড়লে কী হবে?
তুই সত্যিই GOAT। কালীঘাটের GOAT. বলি দেওয়ার পর তারা যেমন ঠ্যাং ছোড়ে, তুইও তেমনি ফাউল হলেই বাবা রে মা রে করে করিস। আহত সৈনিকের ভুমিকায় অভিনয় করে তুই নাম করতে পারবি। কিন্তু গ্রেটেস্ট হওয়া তোর কম্ম নয়।
এবার আসি নেইমারের প্রতিবেশী দেশের ভদ্রলোকের কথায়। পর পর তিনটে বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে হেরেছে। (কিছু বলার নেই। একমাত্র বাঙালি ছাড়া কেউ জোর গলায় বলতে পারে না যে জার্মানিকে হারাবই। তাও সব বাঙালি নয়, পাগলা জগাইই শুধু পারে। কবিতায় পড়েননি, সাত জার্মান একলা জগাই, তবুও জগাই লড়ে।) কিন্তু তাই বলে, চিলি, ক্রোয়েশিয়া, আইসল্যান্ড? ওরে মারাদোনার কথা বাদ দে, ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতারা এই সব টিমকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিত। মারাদোনা হলে তো এদের সঙ্গে গা লাগিয়ে খেলতই না, আসল খেলা তুলে রাখত জার্মানি, ইতালি, ব্রাজিলের জন্য।
মেসির সঙ্গে GOAT-এর একটাই মিল। কিসে বলুন তো? কিসে আবার ছাগলের সেরা চিহ্ন যা তাতে। বাঘের যেমন ডোরাকাটা, সিংহের যেমন কেশর, ছাগলের তেমনই দাড়ি। আর ছাগলের মতই বিপদে পড়লে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বললি, চাপ? মারাদোনার চাপ ছিল না? চাপ না নিলে কেউ গ্রেট হয়? কী বললি, পাশে কেউ নেই? মারাদোনার পাশে কারা ছিল রে? গোটা টিম ভালো খেললে বলব, সর্বকালের সেরা টিম। তোকে সর্বকালের সেরা বলব কেন? ওরে বাপু, ফুটবলটা লড়াই। যারা গ্রেট তারা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়েই প্রতিপক্ষকে অর্ধেক শুইয়ে দেয়। নিজেরা চাপে নুয়ে পড়ে না।
এবার আসি তৃতীয় জনের কথায়। হ্যাঁ এঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আছে বটে। একার কাঁধে দলকে টানার ক্ষমতাও আছে। কিন্তু শুধু টানলে তো হবে না। ভালো খেলাটাও তো খেলতে হবে। ইউরো কাপ জিতলি কিন্তু কেমন ভাবে জিতলি? গোটা টুর্নামেন্টে ৯০ মিনিটের মধ্যে জয় মাত্র একটা খেলায়। নইলে এক্সট্রা টাইম, টাইব্রেকার। রোনাল্ডোবাবুর গোল সংখ্যা মাত্র ৩। ফাইনালেও ল্যাংড়া পায়ে সাইডলাইন থেকে তিড়িংতিড়িং করে লাফাচ্ছিল। অবদান বলতে ওটুকুই। কপাল জোরে জিতে গেছে।
এই তিড়িংতিড়িং লাফানোটাই হল একমাত্র বিষয় যার জন্য একে GOAT বলা যায়। মরক্কোর বিরুদ্ধে গোল করে এমন লাফ লাফাল যে আর একটু হলেই কিষ্কিন্ধ্যা থেকে লঙ্কায় গিয়ে পড়ত। হ্যাঁ স্পেনের বিরুদ্ধে ভালো গোল করেছিস, কিন্তু বাকি ম্যাচে কী করেছিস? একটাই বাঁচোয়া যে ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা সবাই খোঁড়াচ্ছে, নইলে বড় রোনাল্ডোর ব্রাজিল, জিদানের ফ্রান্স, ক্লোজের জার্মানি এদের সামনে পড়লে দেখতাম কেমন GOAT.
শুনুন ভাই, মোদ্দা কথা বলি। ক্লাব ফুটবলে ভালো ভালো প্লেয়ারদের পাশে নিয়ে জিততে অনেকেই পারে। কিন্তু যারা দেশের হয়ে চাপ নিয়ে চাপ জয় করতে পারে, সাধারন মানের সতীর্থদের নিয়ে শক্তিশালী বিপক্ষকে হারাতে পারে, এবং ধারাবাহিকভাবে সুন্দর খেলা উপহার দিতে পারে। তারাই হল গ্রেট। যেমন মারাদোনা, পেলে, ক্রুয়েফ।
নেহাত এখন সেই রকম শক্তিশালী টিম নেই, তাই চ্যাম্পিয়ন রানার্স হচ্ছিস। GOAT নয় তোদের বড়জোর বাঁশবনে শেয়াল রাজা বলতে পারি।
(নন্দ ঘোষ ঠিক করেছেন, বিশ্বকাপের বাজারে তিনি আরও কয়েক কিস্তি লিখবেন। রাশিয়ায় গিয়ে বাংলার সাংবাদিকরা যা বোঝে, না গিয়ে তিনি ঢের ভাল বোঝেন। তার নমুনা তিনি বেঙ্গল টাইমসে তুলে ধরবেন। সুতরাং, তাঁর নতুন ব্যাখার জন্য প্রস্তুত থাকুন)।


