রজত সেনগুপ্ত
১৯৮৮ সাল। মাত্র ২ বছর আগে দিয়েগো মারাদোনা নামে এক পাঁচ ফুটিয়া ভদ্রলোক বাঙালিকে বিশ্বদর্শন করিয়েছেন। কলকাতা লিগ আর আই এফ এ শিল্ডে মজে থাকা বাঙালি প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবলের স্বাদ পেয়েছিল নেহরু গোল্ড কাপের হাত ধরে। কিন্তু ১৯৮৬র মেক্সিকো বুঝিয়ে দিল কলকাতার ফুটবল যদি দীঘি হয়, নেহরু গোল্ড কাপ যদি হয় নদী, বিশ্বকাপ হল সত্যিকারের সমুদ্র। সেই সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাঙালির হাবুডুবু দশা।
এর দুবছর পরেই, অর্থাৎ ১৯৮৮ তে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে বসল ইউরো কাপের আসর। আর্জেন্টিনা নেই, ব্রাজিল নেই, তাতে কী! বাঙালির ততদিনে নেশায় পেয়েছে। জার্মানি তো আছে। ইতালি, স্পেন তো আছে।
কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ফাইনালে উঠল নেদারল্যান্ড। আরে সেই নেদারল্যান্ড- যারা ১৯৭৪, ১৯৭৮-এর রানার্স। আরে জোহান ক্রুয়েফের নাম শুনিসনি? কিন্তু বিপক্ষে যে সোভিয়েত! বাঙালির তখনও বিপ্লব স্পন্দিত বুক। তখনও তার নিজেকে লেনিন বলে মনে হয়।
সব বিপদে ভারতের পাশে সোভিয়েত। বাঙালির পাশে সোভিয়েত। বাবা কাকাদের মুখে শোনা যায়, ১৯৭১-এ বাংলা ভাষার জন্য লড়াইয়ে পাশে ছিল দিল্লির সরকার। আর দিল্লির পাশে ছিল মস্কোর সরকার। তা ছাড়া বছর বছর নেহরু কাপে জিতছে লাল জার্সি পরা রুশ দল। বাঙালি তাই মনে মনে সোভিয়েতকেই সাপোর্ট করল।
কিন্তু ফাইনালে এ কি হল রে! এ যে দেখি কমলা ঝড়। নেদারল্যান্ড ২- সোভিয়েত -০। সেই প্রথম গুলিত দেখা। সেই প্রথম ফুটবলারের হেয়ার স্টাইল দেখা। সেই প্রথম দেখা বাস্তেনের ০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে গোল (যে না দেখেছে সে কী বুঝবে। পারলে ইউ টিউবে দেখে নিন।)
এর দুবছর পরে ইতালিতে বিশ্বকাপ। সবাই ধরেই নিল গুলিতদের ঠেকানো যাবে না। মারাদোনা বনাম গুলিত ভেবে ভেবে বাঙ্গালিও বুঁদ। বহুজাতিক চকোলেট কোম্পানি গুলিত, বাস্তেনের পোস্টার বাজারে আনল। কাগজে পড়েছিলাম, নেদারল্যান্ডের সব বাড়ি কমলা রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকরা গুলিতকে বলেছিল, বিশ্বকাপের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলুন। গুলিত রাজি হননি। সব ছবি তোলা হবে বিশ্বকাপের পর। ডাচ সরকার নাকি বিশ্বকাপ জয়ী সম্মানে আগাম ডাকটিকিটের নকশা প্রস্তুত করে রেখেছিল।
কিন্তু হায়! ঘটনাবহুল এক খেলায় জার্মানির কাছে মুখ থুবড়ে পড়ল গুলিত বাহিনী। রুডি ভোলার, রাইকার্ডের লাল কার্ড। মুখে থুতু কী ছিল না সেই ম্যাচে। ফাইনালে সেই জার্মানিই বধ করল মারাদোনাকে। এবার সোভিয়েতে, থুড়ি রাশিয়ায় বিশ্বকাপ। কিন্তু নেদারল্যান্ড নেই, ১৯৮৮-র ইউরো রানার্স সোভিয়েতও নেই। ক্রয়েফ-গুলিত-বাস্তেন-রাইকার্ড- ক্লুইভার্ত- রবেন- ভ্যান ডার সার- ভ্যান পারসি… সারি সারি কমলা জ্যোতিষ্ক। তমাদের দেখার জন্য আবার চার বছরের অপেক্ষা।
আর সোভিয়েত? হৃদয়েই থাক।
(বেঙ্গল টাইমসও মেতে উঠেছে বিশ্বকাপে। তবে, একেবারেই অন্য আঙ্গিকে। আমাদের শৈশব–কৈশোরের সঙ্গে, আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বকাপ। সেই সব মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখাই উঠে আসছে বেঙ্গল টাইমসে। হয়ত অনেক স্মৃতি, অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে আপনার সঙ্গেও। চাইলে, মেলে ধরতে পারেন। এই বিশ্বকাপ আবহে ফিরে দেখতে পারেন ফেলে আসা সেই দিনগুলোকে।)

