ইতালি নেই, এবার কার জন্য রাত জাগব?‌

দেবায়ণ কুণ্ডু

তখন সবে পা রেখেছে কেবল। ইন্টারনেট নামক শব্দটার সঙ্গে বাঙালির তখনও পরিচয় ঘটেনি। আমার বয়স তখন সবে সাত বছর। ওয়ানের গন্ডি টপকে টু। বিশ্বকাপ কী জিনিস, বোঝার মতো বুদ্ধি তখনও হয়নি। কিন্তু বিশ্বকাপ বলে কথা। বাড়ি থেকে পাড়া, সবাই সেই জ্বরে আক্রান্ত। শুনতাম, বাবা নাকি ব্রাজিলের খুব ভক্ত। কেউ কেউ নাকি আর্জেন্টিনা। কে ব্রাজিল, কে আর্জেন্টিনা, এই দুইয়ের কী তফাত, তখনও বুঝিনি। শুধু একদিন কাগজে দেখলাম, নীল জার্সি পরা একটা লোক। পেছনে লেখা ১০ । হালকা ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, পেছনে পনি টেল। কেন জানি না, লোকটাকে ভাল লেগে গেল।

baggio2
জানলাম, লোকটার নাম রবার্তো বাজ্জিও। ইতালির হয়ে খেলে। এখনও মনে আছে, বাড়ির অন্যদের সঙ্গে ইতালি-আয়ারল্যান্ড ম্যাচটা দেখলাম। ম্যাচটা ইতালি হারল। তখন হার-জিত খুব একটা রেখাপাত করেনি। কেন জানি না, মনে হল, এই দলটাকে সাপোর্ট করা যেতে পারে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার হয়ে তো অনেকেই আছে। আমি না হয় ইতালির সমর্থক হলাম। না, অন্য কারণে নয়। শুধু পনিটেলের ওই লোকটার জন্যই আমি ইতালির। নরওয়েকে হারালাম ১-০ গোলে, মেক্সিকোর সঙ্গে ১-১ ড্র। স্নেহের স্বভাবই নাকি অকারণ অনিষ্টের আশঙ্কা করা। মনে মনে ভয় হতে লাগল, পরের রাউন্ডে যাব তো! বাবা বলত, ইতালি শুরুতে মন্থর, যত খেলা এগোয়, তত খোলস ছাড়ে। তখন দলটা অন্য একটা ছন্দ পেয়ে যায়। সেটাই দেখলাম দ্বিতীয় রাউন্ডে। নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ৮৮ মিনিট পর্যন্ত আমরা পিছিয়ে। হঠাৎ গোল শোধ করে দিল আমার প্রিয় বাজ্জিও। সবাইকে কাটিয়ে প্রায় একক দক্ষতায় গোল। তাহলে ভুল লোককে নিজের নায়ক বাছিনি। তখনও বিস্ময়ের কিছু বাকি ছিল। কারণ, আরও একটা গোল করে ইতালিকে হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিল আমার বাজ্জিও। কোয়ার্টাৱ ফাইনালে স্পেনকে হারালাম ২-১ এ। এবারও বাজ্জিওর গোল। সেমিফাইনালে বুলগেরিয়াকে ২-১। দুটোই বাজ্জিওর। সাত বছরের শিশুর মুগ্ধতা তখন কোথায় পৌঁছতে পারে! এরপর ফাইনাল। সামনে ব্রাজিল। বাবার ব্রাজিল বনাম আমার ইতালি। ফলাফল ০-০। টাইব্রেকার কী জিনিস, তখনও জানি না। শেষ শট নিতে এলেন বাজ্জিও। সেই শট উড়ে গেল বারের ওপর দিয়ে। সব শেষ। সারা রাত বালিশে মুখ রেখে কাঁদলাম। বাবার দল চ্যাম্পিয়ন। তবু আনন্দ করতে পারছে না। বাবার অনুভূতি বোঝার মতো বয়স তখন ছিল না। আমি শুধু বুঝেছি আমার স্বপ্নভঙ্গের কথা।
এরপর ছিয়ানব্ব্ইয়ের ইউরো। সেবার ইতালি খেলতে এল না। আমি একটি ম্যাচও দেখিনি। এবার ৯৮ এর ফ্রান্স বিশ্বকাপ। নতুন সঙ্গী আমার বড়দা, সেও ইতালির সমর্থক। ততদিনে বুঝেছি, এই দলটা আর দশটা দলের মতো নয়। এরা রক্ষণ নির্ভর, এরা একটু হলেও অন্যরকম। কিন্তু সেবার শুরু থেকেই দারুণ ছন্দে। গ্রুপ শীর্ষে থেকে পরের রাউন্ডে, ভিয়েরির গোলে নরওয়েকেও হারানো গেল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে হার ফ্রান্সের কাছে। আবার সেই টাইব্রেকারে। আমার বয়স তখন এগারো। পরেরদিন কিচ্ছু মুখে তুলিনি। আমার জীবনে সেই প্রথম অনশন। রাগে নয়, অভিমানে নয়, যন্ত্রণায়। তাও এমন একজনের জন্য, যাঁকে হয়ত কোনওদিন চোখেও দেখব না। এমন একটা দেশের জন্য, যে দেশে হয়ত কোনওদিন যাওয়াও হবে না।

baggio3
দু’ বছর পরের ইউরো। ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হার। ২০০২ টা মোটেই ভাল যায়নি। আসা যাক ২০০৬ এ। এবার আমার নতুন সঙ্গী ছোট ভাই। আমার তখন ঊনিশ বছর, ভাইয়ের দশ। সে শুরুতে এতটা ইতালি ভক্ত ছিল না। দেখল, দাদা একাই ইতালির হয়ে গলা ফাটায়, ওর পাশে কেউ নেই, দাদাকে একটু সাপোর্ট করা যাক। ম্যাচ ধরে ধরে প্রতিটি মুহূর্ত মনে আছে। থাক সে সব কথা। জার্মানির বিরুদ্ধে লিপ্পি সেবার চার স্ট্রাইকার নামিয়ে দিলেন (দেল পিয়েরো, টোটি, লাইকুন্তা, জিলার্দিনো)। একের পর এক বাধা পেরিয়ে আবার সেই ফাইনালে। এবারেও কি স্বপ্নভঙ্গ! হঠাৎ দেখলাম, আমার আরেক প্রিয় নায়ক জিদান লালকার্ড দেখে মাঠের বাইরে। আবার সেই টাইব্রেকার। আবার হারতে হবে না তো? না, সেবার আমরা চ্যাম্পিয়ন। আমারজীবনে এখনও পর্যন্ত সবথেকে আনন্দের দিন। আরও ভাল লেগেছিল, কারণ সেরা ফুটবলার কানাভারো। রক্ষণের এক ফুটবলার সোনার বল পাচ্ছেন, এ এক অন্যরকম অনুভূতি। ২০১০। কেন জানি না, দুই ভাইয়ের মনে হচ্ছিল, এবার আর বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, দলে অনেকেরই বয়স বেড়ে গিয়েছিল। তবু যুক্তিকে হারিয়ে একটা অদম্য আবেগ, বুড়ো জিদানের ফ্রান্স যদি পারে, ইতালি পারবে না কেন? চার বছর আগে, খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না। যুক্তি এবং মন দুটোই বলছিল, এবার কাজটা কঠিন। তবুও রাত জেগেছি। বাড়ির মধ্যে যথারীতি শিবির বিভাজন ছিল। কিন্তু সহমর্মিতাও কি ছিল না?‌ ব্রাজিল সাত গোল খাওয়ায় আমরাও কি দুঃখ পাইনি?‌ ইতালি ছিটকে যাওয়ায় বাবাও কি কম কষ্ট পেয়েছে?‌ এভাবেই প্রতিবার বিশ্বকাপ নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে আমাদের বাড়িতে।
কিন্তু এবার কার জন্য রাত জাগব?‌ অনেকে বলত, ভারত নেই, কার জন্য বিশ্বকাপ দেখব?‌ আমার মনে এই প্রশ্নটা আসত না। মনে হত, আমার ইতালি তো আছে। এবার সেই ইতালি নেই!‌ বিশ্বকাপের অর্ধেক আকর্ষণ আগেই যেন হারিয়ে গেছে। বাবার ব্রাজিল আছে। কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়ের ইতালি নেই। তবু বেশ কিছু ম্যাচ দেখব। দারুণ কোনও গোল বা পাসিং দেখে লাফিয়ে উঠব। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস কোথাও একটা থেকেই যাবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.