বিশ্বকাপ এলেই আলোচনা শুরু হয়ে যায়, কারা ফেবারিট। কার কোথায় শক্তি, কার কোথায় দুর্বলতা। কারা চমক দিতে পারে? এসব নিয়ে আলোচনা করলেন সুগত রায়মজুমদার।
সামনের ১৪ জুন ২০১৮, বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধন। আয়োজক রাশিয়া। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে ফেবারিট কোনও দেশকেই ধরা যাচ্ছে না। প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি, স্পেন থাকে। কিন্তু এ বছরের ধারণা কিছুটা অন্যরকম। তবু তো ফেবারিট দেশ বাছতেই হবে। ফর্ম অনুযায়ী এবারের বিশ্বকাপে ৫৭ বছর পর ইতালি নেই। সুতরাং সেই জায়গায় ফ্রান্স ও পর্তুগালকে নেওয়া যেতে পারে। আর্জেন্টিনাও আগের দুবার অন্যতম ফেবারিট ছিল কেবল মেসির জন্য। এবারও তাই। মেসি ছাড়া আর্জেন্টিনা ভাবাই যায় না। এবার আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে মেসিকে বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচের মতো অস্বাভাবিক ফর্মে খেলে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছতে হবে। মেসি নিজেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বয়ং মারাদোনাও নিজের দেশের কোচ ও দলের প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন না। আর্জেন্টিনা দলে না আছে ভাল ফর্মের ফরোয়ার্ড, না ডিফেন্স, না আছে নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার। বার্সিলোনায় মেসিকে যে ফর্মে খেলতে হচ্ছে নেইমার ও জাভি না থাকায় এবং পুরনো ফর্মের ইনিয়েস্তাকে না পাওয়া সত্ত্বেও যে কঠিন ভূমিকা নিয়েছেন মেসি, সেই ফর্মেই তাঁকে পুরো বিশ্বকাপে খেলে যেতে হবে। তা হলেই সম্ভব হবে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়।
প্রথমে ব্রাজিলকে ধরছি ফেবারিট হিসেবে। এই দলের খেলোয়াড়রা যদি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, তা হলে তারাই এগিয়ে থাকবে সকলের আগে। যে দলে নেইমারের মতো অপ্রতিরোধ্য খেলোয়াড় থাকে, এ ছাড়াও কুটিনহো, জেসুস, সের্জেই রবার্তো, উইলিয়ানদের মতো খেলোয়াড় থাকেন, সেই দলকে প্রথম ফেবারিট বলাই যায়। বাছাইপর্বেও ব্রাজিল টিটোর কোচিংয়ে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। অলিম্পকেও দুর্দান্ত খেলেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সুতরাং যতক্ষণ ব্রাজিল আছে, ততক্ষণ ব্রাজিলকে প্রথম ফেবারিট ধরা ছাড়া উপায় নেই।

দ্বিতীয়ত, কোনও বিশ্বকাপেই জার্মানিকে ফেবারিট তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না। এখনকার জার্মানি শুধু গতি ও শক্তির ওপর নির্ভর করে না। জার্মানির খেলোয়াড়রা সুন্দর গতি ও পাসিংয়ের মিশ্রণে ওয়াল পাস খেলে যে কোনও দলকে বিধ্বস্ত করার ক্ষমতা রাখে। গত ২০১৪ বিশ্বকাপের পর প্রথম সারির বেশ কিছু খেলোয়াড় অবসর নেওয়ায় কিছুদিনের জন্য জার্মানি ফেবারিটের তালিকায় ছিল না। মনে রাখতে হবে দেশটির নাম জার্মানি। যাদের অতীতের লড়াইয়ের ঐতিহ্য রয়েছে। মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সর্বেসর্বা হিটলার সঙ্গে মাত্র ২টি দেশ ইতালি ও জাপানকে নিয়ে ৬ বছর ধরে বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলিকে কীভাবে নাজেহাল করেছিলেন। সেই দেশের মানুষের রক্তে তো লড়াই থাকবেই। এর প্রমাণ গত বিশ্বকাপে জার্মানি ব্রাজিলকে দ্বিতীয় শ্রেণীর দলে নামিয়ে এনেছিল ৭–১ ফলে হারিয়ে। সেদিন জার্মানি বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রথম ফেবারিট দেশকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছিল। এটা স্মরণ করলে ব্রাজিলবাসীরা ভাবেন, এবারের বিশ্বকাপে যেন ব্রাজিলের সঙ্গে জার্মানির নিচের রাউন্ডে খেলা না হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, জার্মানিকে কেন সব বিশ্বকাপে ফেবারিট ধরা হয়। কিন্তু জার্মানিরও একটা দুর্বলতা আছে। তারা মাঝেমাঝে খেলা থেকে হারিয়ে যান। প্রথমে জার্মানি গোল খেলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে প্রতিপক্ষকে হারানোর ক্ষমতা রাখে। সেজন্যই এই দেশকে বিশ্বের সব দলই ভয় পায়। এই দেশের কোনও তারকার দরকার হয় না। দলগতভাবেই জার্মানির সবাই সবকিছু করতে পারে। এবারের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও জার্মানি ১০টি খেলে ১০টিই জিতে মূলপর্বে শীর্ষে পৌঁছেছে। বিশ্বকাপে জার্মানির সাধারণ খেলোয়াড়রাও অসাধারণ হতে পারেন। গত বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা বেশি সুযোগ পেয়েও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। হিগুয়েন ও মেসি যে গোল মিস করেছিলেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। কারণ এই দলের বিরুদ্ধে বারবার সুযোগ আসে না। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের দুজন অনামী জার্মান খেলোয়াড় শার্লের সেন্টারে বায়ার্ন মিউনিখে ঠিকমতো সুযোগ না পাওয়া গোৎজের অসাধারণ গোলের জন্যই জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়। ওরা সব সময়েই বড় আসরের দল।
এবার আসি স্পেনকেও অন্যতম ফেবারিট ধরা যায়। যে দৃষ্টিনন্দন খেলা অতীতে ব্রাজিল খেলত, সেই খেলাই এখন স্পেন দল খেলে। ওদের খেলা দেখে দর্শকরা আনন্দ পায়। সেজন্যই স্পেনকে ফেবারিটের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না। স্পেন দলটি এবার কোচ লোপেতেগুই অভিজ্ঞতা ও দক্ষ খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি করেছেন। এই দলে ডিফেন্সে রিয়েলের র্যামোস ও বার্সিলোনার স্টপার জেরার্ড পিকে জুটিকে এ মুহূর্তে বিশ্বসেরা বলাই যায়। দু’জনেই ডিফেন্স ও আক্রমণে দক্ষ। এ ছাড়াও মিডফিল্ডে ইনিয়েস্তার মতো নিখুঁত ও ইস্কোর মতো স্টাইলিস্ট ও অত্যন্ত দক্ষ খেলোয়াড় আছেন। এঁদের ক্ষমতা অসাধারণ। যে কোনও সময় এই দু’জন খেলা অনবরত পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু কোচ একটা বড় ভুল করেছেন মোরাতার মতো দক্ষ স্ট্রাইকারকে দল থেকে বাদ দিয়ে। যাঁর অসাধারণ গোলক্ষুধা। সেজন্যই চেলসির কোচ কন্তে তাঁকে দলে নিয়ে দূরদর্শিতার প্রমাণ দিয়েছেন। স্পেনের কোচের এই ভুলই হয়তো স্পেনকে এই বিশ্বকাপে ভোগাতে পারে। মনে রাখতে হবে এই দলের দক্ষ খেলোয়াড়রা এখন প্রবীণ। তাঁদের ফর্মের ওপরই নির্ভর করতে হবে স্পেনকে। বল পজেশনে সবসময় স্পেন এগিয়ে থাকে। কিন্তু দক্ষ স্ট্রাইকারের অভাব আপার রাউন্ডের খেলাগুলিতে অনুভূত হবেই। তবু স্পেনকে ফেবারিট ধরতে হবেই। কারণ এই দলটি নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের ওপর জয় নির্ভর করবে না। প্রয়োজনে র্যামোস, পিকে, ইনিয়েস্তারাও গোল করতে পারেন। যা আমরা দেখেছি ২০১০–এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ইনিয়েস্তার গোলে চ্যাম্পিয়ন স্পেন। সুতরাং স্পেনও অন্যতম দাবিদার ফেবারিটের তালিকায়।
এবার বলতে হবে ফ্রান্সের কথা। এই দেশের সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড়রা ইউরোপের নামী দলে খেলেন। এই দলে এমবাপের মতো খেলোয়াড় আছেন। যাঁকে দেশবাসী জিদানের উত্তরসূরি ভাবেন। এ ছাড়াও গ্রিজম্যান, জিরৌদের মতো গোলদাতা আছেন। ফরোয়ার্ড লাইন তুখোড়। তা ছাড়াও পোগবা, ডেম্বেলে, পায়েটদের মতো খেলোয়াড়রাও ইউরোপের প্রথম শ্রেণীর দলগুলিতে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে নির্ভরতা দিচ্ছেন। সুতরাং এই দেশকে কীভাবে বাদ দেওয়া যায়?
পর্তুগালকেও তালিকায় রাখা যেতে পারে রোনাল্ডোর অস্বাভাবিক ফর্মের জন্য। ভুললে চলবে না, পর্তুগাল এবারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অতীত বলে, যারা ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়, তারা বিশ্বকাপও জেতার ক্ষমতা রাখে। তাদের অন্যতম ফেবারিট হিসেবে ধরাও হয়। স্পেন, জার্মানি সেটা করে দেখিয়েছে। তা ছাড়া এটাই হয়তো রোনাল্ডোর শেষ বিশ্বকাপ। তিনিও নিশ্চয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো দুর্ধর্ষ ফর্মে পৌঁছনোর ক্ষমতা রাখেন। আর ওঁর মতো গোলক্ষুধা ও যে কোনও জায়গা থেকেও গোল করার ক্ষমতা আছে। তা হেডেই হোক, ব্যাকভলিতেই হোক বা জোরালো শটেই হোক। সুতরাং পর্তুগালকে ফেবারিট তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না।
এর পরেও বলা যায়, এবারের বিশ্বকাপে কিছু অঘটনও ঘটে যেতে পারে। কিছু দ্বিতীয় শ্রেণীর দলের কোনও কোনও খেলোয়াড় নিজ দক্ষতায় কোনও অন্যতম ফেবারিট দেশকে হারিয়ে সমর্থকদের হতাশ করে দিতে পারেন।
যেমন সর্বপ্রথমে বলতেই হবে মিশরের মহম্মদ সালাহর নাম। যিনি সম্প্রতি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, ততক্ষণ রিয়েল মাদ্রিদের মতো সবচেয়ে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগজয়ী ও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তারকাসমৃদ্ধ দলকে নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন। সেজন্যই পেশাদারি জমানায় র্যামোসের সঙ্গে একটা বিশ্রী সঙ্ঘাতে তাঁকে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল। সালাহ যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, ততক্ষণ রিয়েল মাদ্রিদ সেন্টার লাইন পর্যন্ত পৌঁছতে পারছিল না সালাহের আতঙ্কে। এই সালাহের বয়স এখন মাত্র ২৫। ব্রাজিলের রোনাল্ডোর মতো অনেক প্রাক্তন খেলোয়াড়ই তাঁর সঙ্গে মেসির মিল খুঁজে পাচ্ছেন। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে এই সালাহের জন্যই রোমার মতো শক্তিশালী দল ৫–০ পিছিয়ে থেকে সালাহ শেষ ১৫ মিনিট আগে বসে যাওয়ায় রোমা ২ গোল দেয় লিভারপুলকে। সুতরাং সালাহের গুরুত্ব দলে কতটা, তা বোঝা যাচ্ছে। এই বিশ্বকাপে বেশ কিছু তরুণ খেলোয়াড় অনেক খেলার ফল পাল্টে দিতে পারেন। মানেকেও বাদ দেওয়া যায় না সেই তালিকায়। তবে বলা যায়, সালাহ যদি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে দেশের হয়ে মাঠে নামতে পারেন, তা হলে অনেক দেশের ঘুম কেড়ে নিতে পারেন।
এ ছাড়াও বেলজিয়ামের ব্রুইন, হ্যাজার্ডরা এই বিশ্বকাপে অনেক দলকে কাঁপিয়ে দিতে পারেন। গত বিশ্বকাপে বেলজিয়াম কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। এবার তাঁরা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারেন ৪ বছরের অভিজ্ঞতা–সমৃদ্ধ হয়ে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্রুইন ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে ইপিএলে চ্যাম্পিয়ন করায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সুতরাং কোনও দেশকেই পুরোপুরি ফেবারিট বলা যাবে না। যা গত বিশ্বকাপে জার্মানিকে দেখেই বোঝা গেছিল, তারা চ্যাম্পিয়ন হতেই এসেছিল। এই বিশ্বকাপে বহু দেশের খেলোয়াড়ই অস্বাভাবিক ফর্মে আছেন। সুতরাং কাউকেই তথাকথিত ফেবারিট না বলে অঘটনের বিশ্বকাপও বলা যেতে পারে।
(বেঙ্গল টাইমসে শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপ জ্বর। আগামী দেড় মাস এই জ্বর থাকবে। বিশ্বকাপ নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নানা রকম লেখা। আপনারাও অংশ নিতে পারেন। আগামী দেড় মাস আপনারাও বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন। পাঠিয়ে দিন বেঙ্গল টাইমসের ঠিকানায়।)
bengaltimes.in@gmail.com
