তিনদিন পর ভোট, সেই সংক্রান্ত মামলার রায় কিনা দু মাস পর! এই ঢিলেমি, এই দীর্ঘসূত্রিতা আসলে কীসের ইঙ্গিত? একটা জট খুলছে, তো আরও নতুন জট তৈরি করছে আদালত। আদালত, তোমারও দূরদৃষ্টিতে টান পড়িয়াছে। কিংবা কী জানি, আদালতের সামনেও হয়ত অন্য চেহারায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে আছে। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
জট ছাড়ানো নয়, নতুন জট লাগানোই যেন আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে হাইকোর্ট হোক বা সুপ্রিম কোর্ট।
আদালত যদি শুরুতেই হস্তক্ষেপ করত, তাহলে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাস কখনই এই জায়গায় পৌঁছত না। জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে লাগামছাড়া সন্ত্রাস। নির্বাচন কমিশন থেকে জেলা প্রশাসন, সবাই কার্যত নিধিরাম সর্দার। হাইকোর্ট বুঝেই পেল না হস্তক্ষেপ করা উচিত না উচিত নয়। দ্বিধা কাটাতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ততদিনে রাস্তায় রাস্তায় লাঠি, বন্দুক, তরোয়াল নিয়ে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে গেছে। হাইকোর্টও হয়ে উঠল এই লাগাতার সন্ত্রাসের দার্শনিক প্রশ্রয়দাতা।
একদিন মনোনয়নের দিন বাড়ানো হল। বিরোধীতা তাতেই উল্লসিত। ভাবলেন, বিরাট জয় এসে গেল। অতি উৎসাহে কেউ কেউ ‘ঐতিহাসিক জয়’ শব্দ দুটোও ব্যবহার করে ফেললেন। কিন্তু বিরোধীরা একবারও ভেবে দেখলেন না, এটা পর্বতের মূষিক প্রসব হল। সেদিন দরকার ছিল কড়া ভর্ৎসনার। কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটেনি বিচারালয়। ফল যা হওয়ার, তাই হল। সেই বাড়তি মনোনয়নের দিনেও জেলায় জেলায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে গেল। আর এসব ক্ষেত্রে ‘অনুপ্রেরণা’র কোনও অভাব ঘটেনি।
তারপর রায় হল অনলাইনের মনোনয়ন জমা করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিরোধীরা আবার উল্লসিত। একবারও ভেবে দেখলেন না, সুপ্রিম কোর্টে এটা সেভাবে দাঁড়াবে না। পঞ্চায়েত আইনে অনলাইন মনোনয়নের ব্যবস্থা নেই। বিচারপতি রাতারাতি কোনও আইন তৈরি করতে পারেন না। তাঁর কাজেরও কিছু সীমারেখা আছে।
যথারীতি সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিল। কিন্তু সেখানে তৈরি হল নতুন জটিলতা। এসব নিয়ে নাকি পরের শুনানি ৩ জুলাই। অর্থাৎ, প্রায় দু মাস। তখন যদি মনে হয়, সেই মনোনয়ন বৈধ, তাহলে ওইসব কেন্দ্রে ফের ভোট হবে? যাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন, তাঁদের জয়ীর শংসাপত্র দেওয়া যাবে না। তাঁদের জয় নাকি স্থগিত। এর ফলে, বিভিন্ন জায়গায় পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনে কী কী জটিলতা হতে পারে, সে ব্যাপারে বিচারপতিদের সম্যক ধারনা ছিল বলে মনে হয় না। বোর্ড গঠন আপাতত দু মাস ঠেকিয়ে রাখা ছাড়া উপায় নেই। কে বলতে পারে, ৩ জুলাই শুনানির পর আবার হয়ত নতুন তারিখ দেওয়া হবে। তার মানে, সব বোর্ড ঝুলে থাকবে? সেইসব কেন্দ্রে যদি পুনরায় ভোট হয়, তাহলে অনেক জায়গায় সমীকরণ বদলে যেতে পারে। এমনকী শাসক যদি পিছিয়ে থাকে, তাহলে তুমুল সন্ত্রাস চলবে। এমনকী জেতার পরেও বিরোধী প্রার্থীর নিস্তার থাকবে না। কীভাবে অন্য দলের জয়ী প্রার্থীকে ছিনিয়ে আনতে হয়, সে কৌশল বর্তমান শাসকেরা বেশ ভালই রপ্ত করেছে।
তিনদিন পর ভোট, সেই সংক্রান্ত মামলার রায় কিনা দু মাস পর! এই ঢিলেমি, এই দীর্ঘসূত্রিতা আসলে কীসের ইঙ্গিত? প্রশাসক দুর্বৃত্তদের পাশে। নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ দাস। এই অবস্থায় আদালতের সক্রিয়তাতেও যদি এত ভাটা পড়ে, তাহলে কাদের পোয়াবারো! একটা জট খুলছে, তো আরও নতুন জট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের কাঠামো না বুঝে, বাস্তব পরিস্থিতি না বুঝে রায় ঘোষণা করলে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে।
আদালত, তোমারও দূরদৃষ্টিতে টান পড়িয়াছে।
কিংবা কী জানি, আদালতের সামনেও হয়ত অন্য চেহারায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে আছে।